বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

সূরা ফাতিহা

 সূরা আল ফাতিহা (আরবি: سورة الفاتحة) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের প্রথম সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ৭ এবং রুকু সংখ্যা ১। ফাতিহা শব্দটি আরবি "ফাতহুন" শব্দজাত যার অর্থ "উন্মুক্তকরণ"। এটি আল্লাহ্ এর পক্ষ থেকে বিশেষ প্রতিদান স্বরূপ। সূরা ফাতিহা অন্যান্য সূরার ন্যায় বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দিয়ে শুরু হয়েছে। আল ফাতিহা সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে বিধায় মক্কী সূরা হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ। সূরা ফাতিহাকে ভেঙে ভেঙে পড়া যায় না বলে একে অখণ্ড সূরা নামেও ডাকা হয়। সূরা ফাতিহাকে ভেঙে পড়ার বিধান নেই।


আয়াতসমূহ ও অর্থ

بِسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ۝‎‎

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে।

ٱلْحَمْدُ لِلَّٰهِ رَبِّ ٱلْعَالَمِينَ ۝‎

আলহামদুলিল্লা-হি রব্বিল আ-লামীন।

সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে।

ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ۝‎

আর রহমা-নির রহীম।

অনন্ত দয়াময়, অতীব দয়ালু।

مَالِكِ يَوْمِ ٱلدِّينِ ۝‎

মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন।

প্রতিফল দিবসের মালিক।

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ۝‎

ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কানাছতা’ঈন।

আমরা শুধু আপনারই দাসত্ব করি এবং শুধু আপনারই নিকট সাহায্য কামনা করি।

ٱهْدِنَا ٱلصِّرَاطَ ٱلْمُسْتَقِيمَ ۝‎

ইহদিনাসসিরা-তাল মুছতাকীম।

আমাদের সরল পথনির্দেশ দান করুন।

صِرَاطَ ٱلَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ۝‎

সিরা-তাল্লাযীনা আন’আম তা’আলাইহিম।

তাদের পথে, যাদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন।

غَيۡرِ ٱلْمَغْضُوبِ عَلَيۡهِمۡ وَلَا اَ۬لضَّآلِّينَ ص۝‎

গাইরিল মাগদূ বি’আলাইহীম ওয়ালাদ্দাল্লীন। (আমিন )

এবং তাদের পথে নয় যারা আপনার ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট । ( কবুল করুন )

ভাবানুবাদ

১:পরম করুণাময়, অতি দয়ালু আল্লাহর নামে।


২:সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে।


৩: অনন্ত দয়াময়, অতীব দয়ালু।


৪:বিচার দিবসের মালিক।


৫:আমরা শুধু আপনারই দাসত্ব করি এবং শুধু আপনারই নিকট সাহায্য কামনা করি।


৬:আমাদের সরল পথনির্দেশ দান করুন।


৭:তাদের পথে, যাদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন, এবং তাদের পথে নয় যারা  আপনার ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট । ( কবুল করুন )


নামকরণ

ফাতিহা শব্দটি আরবি "ফাতহুন" শব্দজাত যার অর্থ "উন্মুক্তকরণ"। এ সূরার বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এর এই নামকরণ করা হয়েছে। যার সাহায্যে কোন বিষয়, গ্রন্থ বা জিনিসের উদ্বোধন করা হয় তাকে 'ফাতিহা' বলা হয়। অন্য কথায় বলা যায়, এ শব্দটি ভূমিকা এবং বক্তব্য শুরু করার অর্থ প্রকাশ করে।[২]


হাদিসে এ সুরার আরও চারটি নাম পাওয়া যায় যার একটি হলো উম্মুল। তবে ইসলামী লেখালিখিতে এ সুরার অন্ততঃ ২৩ অভিধা রয়েছে।[৩] একে সাবআ মাসানী বা বহুল পঠিত সাত আয়াত বলা হয়।


এই সূরাটির অন্য কয়েকটি নাম রয়েছে। যেমন- ফাতিহাতুল কিতাব, উম্মুল কিতাব[৪][৫][৬], সূরাতুল-হামদ, সূরাতুস-সালাত, আস্‌-সাব্‌'য়ুল মাসানী এবং সূরাতুস শেফা।


নাযিল হওয়ার সময়-কাল

এটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের একেবারেই প্রথম যুগের সূরা। বরং হাদীসের নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, এটিই মুহাম্মাদের (সা.) ওপর নাযিলকৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা। এর আগে মাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু আয়াত নাযিল হয়েছিল। সেগুলো সূরা 'আলাক্ব', 'মুয্‌যাম্‌মিল' ও 'মুদ্‌দাস্‌সির' ইত্যাদিতে সন্নিবেশিত হয়েছে।


বিষয়বস্তু

আসলে এ সূরাটি হচ্ছে একটি দোয়া। যে কোন ব্যক্তি এ গ্রন্থটি পড়তে শুরু করলে আল্লাহ প্রথমে তাকে এ দোয়াটি শিখিয়ে দেন। গ্রন্থের শুরুতে এর স্থান দেয়ার অর্থই হচ্ছে এই যে, যদি যথার্থই এ গ্রন্থ থেকে তুমি লাভবান হতে চাও, তাহলে নিখিল বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহর কাছে দোয়া এবং সাহায্য প্রার্থনা করো।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]


মানুষের মনে যে বস্তুটির আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা থাকে স্বভাবত মানুষ সেটিই চায় এবং সে জন্য দোয়া করে। আবার এমন অবস্থায় সে এই দোয়া করে যখন অনুভব করে যে, যে সত্তার কাছে সে দোয়া করছে তার আকাংখিত বস্তুটি তারই কাছে আছে। কাজেই কুরআনের শুরুতে এই দোয়ার শিক্ষা দিয়ে যেন মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সত্য পথের সন্ধান লাভের জন্য এ গ্রন্থটি পড়, সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে এর পাতা ওলটাও এবং নিখিল বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহ হচ্ছেন জ্ঞানের একমাত্র উৎস--- একথা জেনে নিয়ে একমাত্র তার কাছেই পথনির্দেশনার আর্জি পেশ করেই এ গ্রন্থটি পাঠের সূচনা কর।


এ বিষয়টি অনুধাবন করার পর একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কুরআন ও সূরা ফাতিহার মধ্যকার আসল সম্পর্ক কোন বই ও তার ভূমিকার সম্পর্কের পর্যায়ভুক্ত নয়। বরং এ মধ্যকার আসল সম্পর্কটি দোয়া ও দোয়ার জবাবের পর্যায়ভুক্ত। সূরা ফাতিহা বান্দার পক্ষ থেকে একটি দোয়া। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআন তার জবাব । বান্দা দোয়া করে, "হে মহান প্রভু ! আমাকে পথ দেখাও"। জবাবে মহান প্রভু এই বলে সমগ্র কুরআন তার সামনে রেখে দেন, "এই নাও সেই হিদায়াত ও পথের দিশা যে জন্য তুমি আমার কাছে আবেদন জানিয়েছো "।


বৈশিষ্ট্য

এই সূরাটি আল কুরআনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূরা। প্রথমত এ সূরা দ্বারাই পবিত্র কোরআন আরম্ভ হয়েছে এবং এ সূরা দিয়েই সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদত সালাত আরম্ভ করতে হয়। যে সকল সাহাবী সূরা আল-ফাতিহা সর্বপ্রথম নাযিল হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের সে বক্তব্যের অর্থ বোধহয় এই যে, পরিপূর্ণ সূরারূপে এর আগে আর কোনো সূরা নাযিল হয়নি। এ জন্যই এ সূরার নাম "ফাতিহাতুল-কিতাব" বা "কুরআনের উপক্রমণিকা" রাখা হয়েছে।


'সূরা আল্-ফাতিহা' এদিক দিয়ে সমগ্র কোরআনের সার-সংক্ষেপ। এ সূরায় সমগ্র কোরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্ত আকারে বলে দেয়া হয়েছে। কোরআনের অবশিষ্ট সূরাগুলো প্রকারান্তরে সূরা ফাতিহারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা। তাই এ সূরাকে সহীহ হাদীসে 'উম্মুল কিতাব', 'উম্মুল কুরআন', 'কোরানে আযীম' বলেও অভিহিত করা হয়েছে।[৭] হযরত রসূলে কারীম এরশাদ করেছেন যে -


"যার হাতে আমার জীবন-মরণ, আমি তাঁর শপথ করে বলছি, সূরা আল-ফাতিহার দৃষ্টান্ত তাওরাত, ইনজীল, যাবুর প্রভৃতি অন্য আসমানী কিতাবে তো নেই-ই, এমনকি পবিত্র কোরআনেও এর দ্বিতীয় নেই।"


ইমাম তিরমিযী আবু হুরাইরাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলে কারীম আরো বলেছেন যে -


"সূরায়ে ফাতিহা প্রত্যেক রোগের ঔষধবিশেষ।"


সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা

এ সূরার প্রথম ও তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ্‌র গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে আর-রাহমান ও আর-রাহীম উল্লিখিত হয়েছে। রহম শব্দের অর্থ হচ্ছে দয়া, অনুগ্রহ। এই 'রহম' ধাতু হতেই 'রহমান' ও 'রহীম' শব্দদ্বয় নির্গত হয়েছে। 'রহমান' শব্দটি আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কারও জন্য ব্যবহার করা জায়েয নেই। অন্যদিকে 'রহীম' সৃষ্টজগতের কারও কারও গুণ হতে পারে। তবে আল্লাহ্‌র গুণ হলে সেটা যে অর্থে হবে অন্য কারও গুণ হলে সেটা একই অর্থে হবে না।[১]


সূরাটির দ্বিতীয় আয়াতে আল-হামদু কথাটি আশ-শুক্-র্ থেকে অনেক ব্যাপক, যা আধিক্য ও পরিপূর্ণতা বুঝায়। 'আশ-শুক্-র্ লিল্লাহ' বলার অর্থ হতো এই যে, আমি আল্লাহ্‌র যে নিয়ামত পেয়েছি, সেজন্য আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করছি। অপরদিকে 'আল-হামদুলিল্লাহ' এর সম্পর্ক শুধু নিয়ামত প্রাপ্তির সাথে নয়।[১] মানুষ যখন আল্লাহ্‌ ছাড়া অপর কারো গুণ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে তার প্রশংসা করতে শুরু করে, তখন মানুষ তার ভক্তি-শ্রদ্ধার জালে বন্দী হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সে মানুষের দাসত্ব ও মানুষের পূজা করতে আরম্ভ করে। এই অবস্থা মানুষকে শিরকের পথে পরিচালিত করতে পারে। সে জন্য যাবতীয় 'হামদ' একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।[১]


সৃষ্টিজগতকে আলাম এবং বহুবচনে আলামীন বলা হয়। সূরা আশ-শু'আরার ২৩-২৪ আয়াতদুটিতে বলা হয়েছে,


ফিরআউন বলল : "রাব্বুল আলামীন কি?" মূসা বললেন : "যিনি আকাশসমূহ-ভূপৃষ্ঠ এবং এ দু'টির মধ্যবর্তী সমস্ত জিনিসের রব।"


রব হচ্ছেন যিনি সৃষ্টি করা, প্রতিটি জিনিসের পরিমাণ নির্ধারণ করা, পথ প্রদর্শন ও আইন বিধান দেওয়া, লালন-পালন করা, রিযিক্‌ দান করা, জীবনদান করা, মৃত্যু প্রদান করা, সন্তান দেয়া, আরোগ্য প্রদান করা ইত্যাদি সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন।[১] চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ্‌কে 'বিচার দিনের মালিক' বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বিচার দিন সম্পর্কে সূরা আল-ইনফিতারের ১৭-১৯ নং আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে,


"আর কিসে আপনাকে জানাবে প্রতিদান দিবস কী? তারপর বলি, কিসে আপনাকে জানাবে প্রতিদান দিবস কী? সেদিন কোনো মানুষ অন্য মানুষের জন্য কোনো কিছুর ক্ষমতা রাখবে না। আর সেদিন সকল বিষয় হবে আল্লাহর কর্তৃত্বে।"


পঞ্চম আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্যসব উপাস্যের ইবাদাত করা ও সেগুলোর কাছে সাহায্য চাওয়াকে অস্বীকার করা হয়েছে। ইবাদত হল ভয়-ভীতি, আশা-আকাঙ্খার সাথে সেইসব কথা বা কাজ সম্পাদন করা, যা আল্লাহ পছন্দ করেন ও যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন। যেসব কথা ও কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন তা থেকে বিরত থাকাও ইবাদাত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করা অথবা কারো কাছে অলৌকিক সাহায্য কামনা করা শির্ক হিসেবে গণ্য হয়।


সূরাটির ষষ্ঠ আয়াতে হিদায়াত চাওয়া হয়েছে। স্নেহ ও করুণা এবং কল্যাণ কামনাসহ কাউকে মঙ্গলময় পথ দেখিয়ে দেয়া ও মনজিলে পৌঁছিয়ে দেয়াকে আরবী পরিভাষায় হিদায়াত বলে। 'হিদায়াত' শব্দটির দুইটি অর্থ। একটি পথ প্রদর্শন করা, আর দ্বিতীয়টি লক্ষ্য স্থলে পৌঁছিয়ে দেয়া। সিরাত শব্দের অর্থ হচ্ছে রাস্তা বা পথ। আর মুস্তাকীম হচ্ছে, সরল সোজা।[১]


সূরাটির শেষ আয়াত এর পূর্বের আয়াতের 'সরলপথ'-এর ব্যাখ্যা।


সূরা আল-ফাতিহার প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহ্‌র প্রশংসার বর্ণনা করা হয়েছে এবং প্রশংসার সাথে সাথে ঈমানের মৌলিক নীতি ও আল্লাহ্‌র একত্ববাদের বর্ণনাও সূক্ষভাবে দেয়া হয়েছে। তৃতীয় আয়াতে এর দু'টি শব্দে প্রশংসার সাথে সাথে কিয়ামত ও পরকালের কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ আয়াতের এক অংশে প্রশংসা এবং অপর অংশে দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়েছে। مَـالِكِ يَوْمِ الدِّينِ - এর মধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মানুষ পরকালেও আল্লাহ্‌র মুখাপেক্ষী। প্রতিদান দিবসে আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য পাওয়া যাবে না। একজন বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তি মনের গভীরতা থেকেই এ স্বতঃস্ফুর্ত স্বীকৃতি উচ্চারণ করছে যে, আমরা তোমাকে ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করি না। এ মৌলিক চাহিদাই إِيَّاكَ نَعْبُدُ তে বর্ণনা করা হয়েছে। অভাব পূরণকারী একক সত্তা আল্লাহ্‌, সুতরাং নিজের যাবতীয় কাজে সাহায্যও তার নিকট প্রার্থনা করবে। এ মৌলিক চাহিদাই বর্ণনা وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ -এ করা হয়েছে। মোটকথা, এ চতুর্থ আয়াতে একদিকে আল্লাহ্‌র প্রশংসার সাথে একথারও স্বীকৃতি রয়েছে যে, ইবাদত ও শ্রদ্ধা পাওয়ার একমাত্র তিনিই যোগ্য। অপরদিকে তার নিকট সাহায্য ও সহায়তার প্রার্থনা করা এবং তৃতীয়তঃ আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করার শিক্ষাও দেয়া হয়েছে। শেষ তিনটি আয়াতে মানুষের দোয়া ও আবেদনের বিষয়বস্তু এবং এক বিশেষ প্রার্থনা পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে।


সম্পর্কিত হাদিস

একটি হাদীসে মুহাম্মাদের এক সঙ্গীর গল্প বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি এক বিষাক্রান্ত আদিবাসী প্রধানের ঔষধ হিসাবে আল-ফাতিয়াহ পাঠ করেছিলেন। হাদীস অনুসারে মুহাম্মদ পরে সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি কীভাবে জানলেন যে এটি রুক্বায়াহ [ঔষধ]?"[৫] মুহাম্মদ আল বুখারী তার সংগ্রহে রেকর্ড করেছেন:


আবু সাইদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত:

যখন আমরা আমাদের একটি যাত্রায় ছিলাম, আমরা এমন এক জায়গায় ফিরে গেলাম যেখানে একজন দাসী মেয়ে এসে বলল, "এই গোত্রের প্রধান বিচ্ছু দ্বারা আহত হয়েছিল এবং আমাদের লোকেরা উপস্থিত নেই; তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে তাকে চিকিৎসা করতে পারে (কিছু পাঠ করে)?" তারপরে আমাদের একজন লোক তার সাথে চলে গেল। যদিও আমরা মনে করিনি যে তিনি এই জাতীয় কোনও চিকিৎসা জানতেন। কিন্তু তিনি কিছু পাঠ করে চিকিৎসা করলেন এবং অসুস্থ লোকটি সুস্থ হয়ে উঠল এবং তারপরে তিনি তাকে ত্রিশটি ভেড়া উপহার দিয়েছিলেন এবং (পুরস্কার হিসাবে) আমাদেরকে দুধ পান করান। তিনি ফিরে আসলে, আমরা আমাদের বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি কি কিছু পাঠ করে চিকিৎসা করা জানেন?" তিনি বলেছিলেন, "না, তবে আমি কেবল সূরা আল-ফাতিহা আবৃত্তি করে চিকিৎসা করেছি।" আমরা বললাম, আমরা মদীনা পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত বা নবীকে জিজ্ঞাসা করার আগ পর্যন্ত কিছু না বলতে (এ সম্পর্কে), আমরা রাসূলের নিকট উল্লেখ করেছিলাম (আমরা যে মেষগুলি নিয়েছিলাম তা গ্রহণ করা বৈধ ছিল কি না তা জানতে) । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি কীভাবে জানতে পেরেছিলেন যে এটি (আল-ফাতিহা) চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে? আপনার পুরস্কার বিতরণ করুন এবং আমার জন্য এটির একটি অংশও অর্পণ করুন।"


— মুহাম্মদ আল বুখারী, সহীহ আল বুখারী [৮]

অনুরূপ সংস্করণ পাওয়া যায়: আল বুখারী: ০০৭.০৭১.৬৪৫[৯] — ঔষধ; আল বুখারী: ০০৭.০৭১.৬৩৩[১০] — ঔষধ; আল বুখারী: ০০৭.০৭১.৬৩২[১১] — ঔষধ


মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ লিপিবদ্ধ করেছেন আবু হুরায়রাহ বলেছিলেন যে মুহাম্মাদ বলেছেন:


কেউ যদি এমন প্রার্থনা দেখে যেখানে সে উম্মুল কুরআন তিলাওয়াত করে না, [১২] তবে এর ঘাটতি রয়েছে [তিনি এই তিনবার বলেছেন] এবং তা সম্পূর্ণ হয় না।


— মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ, সহিহ মুসলিম''[১৩][১৪]

অনুরূপ একটি কাহিনী আল বুখারীতে পাওয়া যায়: ০০১.০১২.৭২৩[১৫]—সালাতের বৈশিষ্ট্যসমূহ।


মুসলিম ইবনে আল হাজ্জাজ লিপিবদ্ধ করেছেন:


"হযরত জিব্রাইল (আঃ) যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বসে ছিলেন, তখন তিনি তাঁর উপরে একটি শব্দ শুনলেন এবং মাথা উঠালেন। তিনি বললেন: 'এটি আকাশের একটি দরজা যা আজ খোলা হয়েছে এবং যা আজকের আগে কখনও খোলা হয়নি।' সেখান থেকে একজন ফেরেশতা নেমে এসেছিলেন। এবং তিনি (হযরত জিব্রাইল) বলেছেন: 'এটি এমন এক ফেরেশতা যিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, যিনি এর আগে কখনও অবতরণ করেননি।' তিনি (সেই ফেরেশ্তা) শান্তির শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেনঃ দুটি নূরের সুসংবাদ দাও; যার পূর্বে আপনার কোন নবীকে দান করা হয়নি: কিতাবের সূরা ফাতিহা (সূচনা অধ্যায়) এবং সূরা বাকারার শেষ। আপনি তাদের এটি দেওয়া ছাড়া একটি শব্দও পাঠ করবেন না।


— মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ, সহিহ মুসলিম[১৬]

সুরা আল-ফাতিহার উপকার ও ফযীলত

হাদীসসমূহে বর্ণিত ফজিলত ও উপকারিতা (আরবি: فضائل ) এর কারণে কিছু সূরাকে ইসলামের অনুসারীরা বিশেষ গুরুত্ব দেয়। বিভিন্ন হাদীসের কাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের মধ্যে পরিবর্তিত হয় এবং একটি হাদীসের নিশ্চিত সত্যতার বিভিন্ন স্তরের শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন পদ রয়েছে।


সুন্নি অনুযায়ী উপকার

অন্যতম সেরা সূরা

আহমদ ইবনে হাম্বল তাঁর মুসনাদে (হাদিস সংকলনে) লিপিবদ্ধ করেছেন যে আবু সা'ইদ বিন আল-মু'আললা বলেছেন: "যখন নবী আমাকে ডেকেছিলেন তখন আমি প্রার্থনা করছিলাম, সুতরাং নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে উত্তর দিলাম না। আমি তখন তার কাছে গেলাম এবং সে বলল, 'তোমাকে আসতে বাধা দেয় কি?' আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি প্রার্থনা করছিলাম।' তিনি বললেন, 'আল্লাহ কি বলেননি,' হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে (তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে) এবং (তাঁর) রাসূলের উত্তর দিন, যখন তিনি আপনাকে তাঁর কাছে ডাকেন, যা আপনাকে জীবন দান করে। " ? ' তিনি তখন বলেছিলেন, 'আপনি মসজিদ ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি আপনাকে কোরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিখিয়ে দেব।' তিনি আমার হাতটি ধরেছিলেন এবং যখন তিনি মসজিদ ছেড়ে যাচ্ছেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলেছিলেন: "আমি আপনাকে কোরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিখিয়ে দেব।" উত্তরে তিনি বলেন, 'হ্যাঁ' "আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল-আলামীন," এটি সাতটি বারবার আবৃত (আয়াত) এবং আমাকে দান করা মহিমান্বিত কুরআন। " (আল বুখারী, আবু দাউদ, আন-নাসাই এবং ইবনে মাজাহও এ হাদীসটি লিপিবদ্ধ করেছেন।)


রোগ নিরাময়ের জন্য আল-ফাতিহা ব্যবহৃত হয়েছিল

আল বুখারী তার সংগ্রহে লিপিবদ্ধ করেছেন: আবু সা 'ইদ আল খুদরী বলেছেন: "আমরা যখন আমাদের একটি যাত্রায় ছিলাম, তখন আমরা এমন এক জায়গায় ফিরে গেলাম যেখানে একজন দাসী এসে বলল," এই গোত্রের প্রধান বিচ্ছু দ্বারা আহত হয়েছিল এবং আমাদের লোকেরা উপস্থিত নেই; তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে তাকে চিকিৎসা করতে পারে (কিছু পাঠ করে)? " তারপরে আমাদের একজন লোক তার সাথে চলে গেল যদিও আমরা মনে করি নি যে তিনি এই জাতীয় কোনও চিকিৎসা জানেন। কিন্তু তিনি কিছু পাঠ করে চিকিৎসা করলেন এবং অসুস্থ লোকটি সুস্থ হয়ে উঠল এবং তারপরে তিনি তাকে ত্রিশটি ভেড়া উপহার দিয়েছিলেন এবং আমাদেরকে দুধ পান করান (পুরস্কার হিসাবে)। তিনি ফিরে আসলে, আমরা আমাদের বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি কি কিছু পাঠ করে চিকিৎসা করা জানেন?" তিনি বলেছিলেন, "না, তবে আমি কেবল সূরা আল-ফাতিহা আবৃত্তি করে চিকিৎসা করেছি।" আমরা বললাম, আমরা মদীনা পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত বা নবীকে জিজ্ঞাসা করার আগ পর্যন্ত কিছু না বলতে (এ সম্পর্কে), আমরা রাসূলের নিকট উল্লেখ করেছিলাম (আমরা যে মেষগুলি নিয়েছিলাম তা গ্রহণ করা বৈধ ছিল কি না তা জানতে) । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি কীভাবে জানতে পেরেছিলেন যে এটি (আল-ফাতিহা) চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে? আপনার পুরস্কার বিতরণ করুন এবং আমার জন্য এটির একটি অংশও অর্পণ করুন। " (আল বুখারী ০০৬.০৬১.৫২৯ - কুরআনের ফজিলত)


(অনুরূপ সংস্করণগুলিতে পাওয়া গেছে: আল বুখারী: ০০৭.০৭১.৬৪৫ - ঔষধ; আল বুখারি: ০০৭.০৭১.৬৩৩ - ঔষধ; আল বুখারী: ০০৭.০৭১.৬৩২ - ঔষধ)


নামাজে প্রয়োজনীয়তা

মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ লিপিবদ্ধ করেছেন হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেছেন যে নবী বলেছেন:


"যে ব্যক্তি এমন কোন সালাত আদায় করে যাতে সে উম্মুল কুরআন (যেমন, আল-ফাতিহা) পড়ে না, তবে তার সালাত অসম্পূর্ণ।" (সহিহ মুসলিম) (আল বুখারীতে একই ধরনের কাহিনী পাওয়া গেছে: ০০১.০১২.৭২৩ - প্রার্থনার বৈশিষ্ট্য)


দুই নূরের একটি

মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ লিপিবদ্ধ করেছেন ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন:


"হযরত জিব্রাইল (অর্থাৎ ফেরেশতা গ্যাব্রিয়েল) যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বসে ছিলেন, তখন তিনি তাঁর উপরে একটি শব্দ শুনলেন এবং মাথা উঠালেন। তিনি বললেন: 'এটি আকাশের একটি দরজা যা আজ খোলা হয়েছে এবং যা আজকের আগে কখনও খোলা হয়নি।' সেখান থেকে একজন ফেরেশতা নেমে এসেছিলেন। এবং তিনি (হযরত জিব্রাইল) বলেছেন: 'এটি এমন এক ফেরেশতা যিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, যিনি এর আগে কখনও অবতরণ করেননি।' তিনি (সেই ফেরেশ্তা) শান্তির শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেনঃ দুটি নূরের সুসংবাদ দাও; যার পূর্বে আপনার কোন নবীকে দান করা হয়নি: কিতাবের সূরা ফাতিহা (সূচনা অধ্যায়) এবং সূরা বাকারার শেষ। আপনি তাদের এটি দেওয়া ছাড়া একটি শব্দও পাঠ করবেন না। (সহিহ মুসলিম)


"যখন আপনি নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন [ঘুমের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন] এবং আপনি [বইয়ের সূচনা অধ্যায়] এবং সূরা আল-ইখলাস তিলাওয়াত করেন, তখন আপনি মৃত্যু ব্যতীত সমস্ত কিছু থেকে সুরক্ষিত হয়ে পড়ে..." [দুর্বল ধায়েফ আত-তারগীব ওয়া তারহেব: ৩৪]


"ফাতিহা ও আয়াতুল কুরসী: কোন দাস কখনই তাদের ঘরে এইদুটি আবৃত্তি করবে না; এছাড়া সেদিন কোনও জিন বা মানবের কোন খারাপ দৃষ্টি তাদেরকে প্রভাবিত করবে না..." [ধাইফ আল জাম আমি আস-সাগীর:৩৯৫২; আলেম আলবানীর মতে দুর্বল। "ফাতিহা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।" [দুর্বল ধইফ আল জাম আমি আস-সাগীর: ৩৯৪৯]


শিয়া অনুযায়ী উপকার

মুহাম্মাদ (সাঃ) একজন সাহাবী বর্ণনা করেছেন যে তিনি একবার মুহাম্মদের (সাঃ) উপস্থিতিতে এই সূরাটি তেলাওয়াত করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, "যার হাতে আমার প্রাণ, তার দ্বারা এ জাতীয় অনুরূপ কিছু তাওরাতে (তাওরাত) , ইনজিল ( সুসমাচার), জাবুর (সাম) বা এমনকি কোরআনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।"


মুহাম্মদ (সাঃ) একবার জাবির ইবনে আবদাল্লাহ আনসারিকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমি কি আপনাকে এমন একটি সূরা শিখিয়ে দেব যার সাথে পুরো কুরআনে আর কোন তুলনা নেই?" জাবির জবাব দিলেন, "হ্যাঁ, এবং হে আল্লাহর নবী (সাঃ) আমার পিতা-মাতা আপনার উপর বন্দিত্বমোচন করতে পারেন।" সুতরাং মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে সূরা আল-ফাতিহা শিখিয়েছিলেন। তখন মুহাম্মদ (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, "জাবির, আমি কি এই সূরা সম্পর্কে কিছু বলতে পারি?" জাবির জবাব দিলেন, "হ্যাঁ, এবং হে আল্লাহর নবী আমার পিতা-মাতা আপনার উপর বন্দিত্বমোচন করতে পারেন।" মুহাম্মদ বলেছিলেন, "এটি (সূরা আল-ফাতিহা) মৃত্যু ব্যতীত প্রতিটি অসুস্থতার নিরাময়।"


ইমাম আবুআবদিল্লাহ জাফর আস-সাদিক বলেছেন যে যার রোগ সুরা আল ফাতিহার দ্বারা নিরাময় করা যায় না, তবে সেই ব্যক্তির কোন চিকিৎসা নেই। একই বর্ণনায় লেখা আছে যে এই সূরাটি শরীরের যে অংশে ব্যথা হচ্ছে, সে অংশে ৭০ বার তেলাওয়াত করা হলে ব্যথা অবশ্যই দূর হবে। প্রকৃতপক্ষে এই সূরার শক্তি এতটাই বেশি যে বলা হয়ে থাকে যে, যদি কেউ এটি একটি মৃত দেহের উপরে ৭০ বার তেলাওয়াত করে, তবে সেই দেহটি চলতে শুরু করলে (অর্থাৎ জীবনে ফিরে আসে) তা আপনাকে অবাক করা উচিত নয়। সুরা ফাতিহা শারীরিক ও আধ্যাত্মিক অসুস্থতাও নিরাময় করে।


ইবলিস ৪টি অনুষ্ঠানে শোক প্রকাশ করে

আম্বারী তাঁর "কিতাবাবুর-রাদ" গ্রন্থে মুজাহিদ ইবনে জাবরের কাছ থেকে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তা'আলার অভিশপ্ত ইবলিস চারবার শোক করেছিলেন: প্রথমে যখন তাকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল; দ্বিতীয়ত যখন তাকে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল; তৃতীয়ত যখন মুহাম্মদকে নবুওয়াত দেওয়া হয়েছিল; চতুর্থত যখন সূরা ফাতিহা নাযিল হয়েছিল এবং তা মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছিল।


সূরা

 সূরা (আরবি: سورة) হচ্ছে ইসলামী পরিভাষায় কুরআনের এক একটি অধ্যায়ের নাম। তবে এটি সাধারণ পুস্তকের অধ্যায়ের মত নয় বরং বিশেষভাবে কেবল কুরআনের বৈশিষ্ট্যের জন্যই এর উৎপত্তি। তাই এটি প্রকৃত অর্থেই কুরআনের একটি পরিভাষা, যাকে কেবল কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাখ্যা করা যায়। কুরআনে ১১৪টি সূরা রয়েছে, প্রত্যেকটি কে আয়াত বিভক্ত করা হয়েছে।[১] কুরআনের প্রথম সূরা হলো "আল ফাতিহা" এবং শেষ সূরার নাম "আন-নাস্"। দীর্ঘতম সূরা হলো "আল বাকারা" যেখানে ২৮৬ টি আয়াত রয়েছে[২] এবং ক্ষুদ্রতম সুরা সুরা আল কাউসার। সূরা "তাওবা" ব্যতীত সকল সূরা শুরু হয়েছে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দিয়ে এবং সুরা আন নামলে মোট দু'বার বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম আছে। একটি সূরা বা এর অংশবিশেষ অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট বা কারণকে বলা হয় শানে নুযূল।[৩]



আল ফাতিহা, কুরআন শরীফের প্রথম সূরা।

শব্দগত উৎপত্তি

সূরা শব্দটি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময় একটি অংশ বা কুরআনের আয়াতের একটি সেটের অর্থ সহ একটি শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এর প্রমাণ হচ্ছে কুরআনে একাধিক স্থানে সূরা শব্দটির আবির্ভাব যেমন আয়াত ২৪:১: "একটি সূরাহ যা আমি নাযিল করেছি আর তা ফরয করে দিয়েছি, আর তার ভেতরে আমি সুস্পষ্ট আয়াত নাযিল করেছি, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।"[৪] কুরআনে বহুবচন আকারেও উল্লেখ করা হয়েছে: নাকি তারা বলে, ‘সে এটা রটনা করেছে’? বল, ‘তাহলে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা বানিয়ে নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া যাকে পার ডেকে আন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।[৫]


১৯৩৮ সালে আর্থার জেফ্রি বলেন যে সিরিয়াক শব্দ সুরাত থেকে প্রাপ্ত যার অর্থ 'লেখা'।[৬]


অধ্যায়ের কালানুক্রমিক ক্রম

কুরআনের অধ্যায়গুলি প্রকাশের কালানুক্রমিক ক্রমে সাজানো হয়নি, এবং সুনির্দিষ্ট আদেশ পণ্ডিতদের এড়িয়ে গেছে। ঐতিহ্য অনুযায়ী, মুহাম্মদ তার সঙ্গীদের প্রতিটি ওয়াহির ঐতিহ্যগত স্থান বলেছিলেন যেমন তিনি এটি প্রকাশ করেছিলেন,[৭] এবং পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন বিশেষজ্ঞ ডাব্লুএম থিওডোর ডি বারি বর্ণনা করেছেন যে, "কুরআন পাঠ্য সংগ্রহ এবং সংহিতাকরণের চূড়ান্ত প্রক্রিয়াটি একটি অতি-সুক্ষ নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল: ঈশ্বরের কথাগুলি কোনওভাবেই মানুষের হস্তক্ষেপের দ্বারা বিকৃত বা নিষ্ক্রিয় হওয়া উচিত নয়। এই কারণে, অসংখ্য অহী সম্পাদনা, বিষয়গত ইউনিটে তাদের সংগঠিত করার বা কালানুক্রমিক ক্রমে উপস্থাপন করার কোনও চেষ্টা করা হয়নি..."।[৮]


প্রাথমিক প্রচেষ্টা

বেশ কয়েকজন মধ্যযুগীয় ইসলামিক লেখক বিভিন্ন ফলাফল সহ অধ্যায়গুলির একটি কালানুক্রমিক ভাবে আদেশিত তালিকা সংকলন করার চেষ্টা করেছিলেন। যেহেতু মুহাম্মদ বা তার সঙ্গীদের সময় কার কোন প্রেরিত প্রতিবেদন বিদ্যমান নেই, তাদের কাজগুলো অগত্যা পণ্ডিতদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে এবং কোনটিই অষ্টম শতাব্দীর প্রথম প্রান্তিকের আগে উৎদ্ভ হয়নি। একটি সংস্করণ আব্দ আল-কাফির পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি রচনায় দেওয়া হয়েছে, এবং কুরআনের মানক (আদর্শ) মিশরীয় সংস্করণ (১৯২৪) দ্বারা প্রদত্ত কালানুক্রমিক ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।[৯][১০][১১] আবু সালেহ আরেকটি তালিকা উল্লেখ করেছেন, অন্যদিকে আবু সালেহ-এর একটি উল্লেখযোগ্য ভিন্ন সংস্করণ 'কিতাব মাবানি' গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। আর একটি, দশম শতাব্দী থেকে, ইবনে নাদিম দ্বারা প্রদত্ত।[৯]


বেশ কয়েকটি আয়াত নির্দিষ্ট ঘটনাগুলির সাথে যুক্ত যা তাদের তারিখ করতে সহায়তা করে। মুহাম্মদের উপর অবতীর্ণ প্রথম আয়াত ছিল ৯৬ অধ্যায় (বছর ৬০৯)। আয়াত ১৬:৪১ এবং ৪৭:১৩ এ মুসলমানদের অভিবাসন বা হিজরতকে বোঝায় যা ৬২২ সালে সংঘটিত হয়েছিল। আয়াত ৮:১-৭ এবং ৩:১২০-১৭৫ এ যথাক্রমে বদর (৬২৪) ও উহুদ (৬২৫) এর যুদ্ধ কে বোঝায়। মুহাম্মদের শেষ হজ্বের কথা ৫:৩ এ উল্লেখ করা হয়েছে যা ৬৩২ সালে ঘটেছিল, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। এই পদ্ধতিটি সীমিত উপযোগিতার কারণ কুরআন মুহাম্মদের জীবন বা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাথমিক ইতিহাস বর্ণনা করে কেবল ঘটনাক্রমে এবং বিশদে নয়। বস্তুত, খুব কম অধ্যায়ে মুহাম্মদের জীবনে সংঘটিত ঘটনাবলীর স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।[৯]


আধুনিক কাজ

থিওডোর নলডেকের কালপঞ্জি এই ধারণার উপর ভিত্তি করে যে কুরআনের শৈলী বিপরীত ছাড়াই এক দিকে পরিবর্তিত হয়।[১২] নলদেক অধ্যায়ের শৈলী এবং বিষয়বস্তু অধ্যয়ন করেন এবং ধরে নেন যে প্রথমে, পরে (মাদানী) অধ্যায় এবং আয়াত এবং সাধারণত পূর্ববর্তী (মাক্কী) এর চেয়ে ছোট এবং দ্বিতীয়ত, যে পূর্ববর্তী মাক্কী আয়াতে একটি স্বতন্ত্র ছড়াশৈলী রয়েছে আর পরবর্তী আয়াতগুলিতে বেশি গদ্যেশৈলী আছে।[১৩] নলদেক অনুসারে, পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে: তাদের মধ্যে অনেকগুলিতে শপথের বা কসমের সাথে শুরু হয়েছে যেখানে আল্লাহ মহাজাগতিক ঘটনাদ্বারা শপথ করেন, তাদের সাধারণ থিম রয়েছে (এস্চ্যাটোলজি বা পরকাল, সৃষ্টি, ধার্মিকতা, মুহাম্মদের মিশনের বা দাওয়াতের প্রমাণীকরণ এবং মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডন সহ), এবং কিছু মক্কী অধ্যায়ের একটি স্পষ্ট 'ত্রিপাক্ষিক' কাঠামো রয়েছে (উদাহরণস্বরূপ অধ্যায় ৪৫, ৩৭, ২৬, ১৫, ২১)। ত্রিপাক্ষিক অধ্যায়গুলি একটি সংক্ষিপ্ত সতর্কীকরণ দিয়ে শুরু হয়েছে, তারপরে অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে এক বা একাধিক আখ্যান, এবং অবশেষে মুহাম্মদের সমসাময়িকদের সম্বোধন করে এবং তাদের ইসলামে আমন্ত্রণ জানায়। অন্যদিকে, মাদানী আয়াতগুলি দীর্ঘ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আইন এবং নির্দেশনা প্রদানের জন্য ছড়া এবং উদ্বেগের একটি স্বতন্ত্র শৈলী রয়েছে।[৯]


রিচার্ড বেল তার গবেষণার সূচনা বিন্দু হিসেবে নলদেকের কালপঞ্জি গ্রহণ করেন, তবে বেল বিশ্বাস করেন না যে নলদেক শৈলীর মানদণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মুহাম্মদের মিশনে একজন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রগতিশীল পরিবর্তন দেখেছিলেন যিনি একেশ্বরবাদকে একটি সর্বাধিনায়কের স্বাধীন নেতাহিসাবে প্রচার করেছিলেন। বেলের জন্য মুহাম্মদের মিশনে এই রূপান্তর নলদেক শৈলীর মানদণ্ডের তুলনায় বেশি নির্ণায়ক ছিল। বেল যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, যে সব অনুচ্ছেদে ইসলাম ও মুসলিমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বা মুহাম্মদের অনুসারীরা একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা পরে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কুরআনকে তিনটি প্রধান পর্বে শ্রেণীবদ্ধ করেন: প্রাথমিক কাল, কুরআনীয় সময়কাল এবং বইয়ের সময়কাল।[৯] রিচার্ড বেল অধ্যায়ের পরিবর্তে আয়াতগুলির কালপঞ্জি নিয়ে কাজ করেছিলেন। ওহী নাজিলের সময়কালের জন্য বেলের অন্তর্নিহিত পদ্ধতিটি অনুমান করে যে প্রকাশের স্বাভাবিক এককটি সংক্ষিপ্ত উত্তরণ এবং প্যাসেজগুলি ব্যাপকভাবে সম্পাদনা এবং পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে।[১৪]


মেহেদি বাজারগান কুরআনকে ১৯৪ টি স্বাধীন অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে কিছু অধ্যায়কে একক ব্লক হিসাবে অক্ষত রেখে এবং অন্যগুলোকে দুই বা ততোধিক ব্লকে বিভক্ত করে। তারপরে তিনি গড় পদ্য দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি অনুসারে ব্লকগুলি পুনর্বিন্যস্ত করেছিলেন। তিনি যে আদেশটি প্রস্তাব করেছেন তা কালানুক্রমিক ক্রম। বাজারগান ধরে নিয়েছিলেন যে সময়ের সাথে সাথে পদ্যদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় এবং তিনি এই অনুমানটি প্যাসেজগুলি পুনর্বিন্যাস করতে ব্যবহার করেছিলেন।[১২]


ইসলামিক স্টাডিজের একজন পণ্ডিত নীল রবিনসনের অভিমত যে কুরআনের শৈলী ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই এবং তাই শৈলী সবসময় কখন এবং কোথায় একটি অধ্যায় নাজিল হয়েছিল তার নির্ভরযোগ্য সূচক নাও হতে পারে। রবিনসনের মতে, লেখকত্বের কালপঞ্জির সমস্যা এখনও সমাধান করা যায়নি।[৯]


কুরআনের অধ্যায়ের নাম

মূল নিবন্ধ: কুরআনের সূরাসমূহের তালিকা

কুরআনে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কাছে অবতীর্ণ আয়াত ও অধ্যায়গুলো তাদের সাথে সংযুক্ত কোন উপাধি নিয়ে আসেনি। মুহাম্মাদ (সাঃ), যেমন আমরা হাদিসে কিছু প্রতিবেদনে পাই, সংক্ষিপ্ত অধ্যায়গুলি নাম দ্বারা নয়, বরং তাদের প্রথম আয়াত দ্বারা উল্লেখ করা হত। যেমন: আবু হুরাইরা মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করে বলেছেন, "আল-হামদু লিল্লাহি রাব ইল-আলামিন" হচ্ছে কুরআনের মা, কিতাবের মা এবং গৌরবময় কুরআনের সাতটি বার বার বলা আয়াত।"[১৫] আমরা এমন রিপোর্টও পাই যেখানে মুহাম্মদ (সাঃ) তাদের নাম দিয়ে উল্লেখ করতেন। যেমন, আব্দুল্লাহ বিন বুরাইদাহ তার পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন, "আমি নবীর সাথে বসে ছিলাম এবং আমি তাকে বলতে শুনেছি, 'সূরা উল-বাকারা শিখো, কারণ এটি শেখায় বারাকাহ বা বরকত রয়েছে, তা উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে দুঃখ রয়েছে এবং জাদুকররা এটি মুখস্থ করতে পারে না।[১৬]


আরব ঐতিহ্য, সেই সময়ের অন্যান্য উপজাতীয় সংস্কৃতির অনুরূপ, তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জিনিসের নাম ছিল। তারা এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে কুরআনিক অধ্যায়ের নাম দেয়। অধিকাংশ অধ্যায়ের নাম হাদিসে পাওয়া যায়। কিছু তাদের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু অনুযায়ী নামকরণ করা হয়েছিল, যেমন আল-ফাতিহা (উদ্বোধনী) এবং ইউসুফ (জোসেফ), এবং কিছু অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম শব্দের জন্য নামকরণ করা হয়েছিল, যেমন কাফ, ইয়া-সিন এবং আর-রহমান। অধ্যায়ে সংঘটিত একটি অনন্য শব্দ অনুসারে কিছু সূরার নামকরণ করা হয়েছিল, যেমন আল-বাকারাহ (গরু), আন-নুর (আলো), আল-নাহল (মৌমাছি), আয্‌-যুখরুফ (সোনার অলঙ্কার), আল-হাদিদ (লোহা), এবং আল-মাউন (ছোট দয়া)।


বেশিরভাগ অধ্যায়ের নাম গুলি এখনও আজ পর্যন্ত অভ্যস্ত। বেশ কয়েকটি একাধিক নামে পরিচিত: অধ্যায় আল-মাসাদ (পাম ফাইবার) আল-লাহাব (শিখা) নামেও পরিচিত। সূরা ফুসিলাত (বিস্তারিত ব্যাখ্যা) হা-মীম সাজদা ("... এটি একটি অধ্যায় যা হা মীম দিয়ে শুরু হয় এবং যেখানে সিজদা সম্পাদনের প্রয়োজন এমন একটি আয়াত ঘটেছে।")[১৭]


কুরআনে সমন্বয়

ইসলামী পরিমণ্ডলের সাহিত্যে "নাজম" এবং "মুনাসাবাহ", 'সমন্বয়', 'পাঠ্য সম্পর্ক', 'আন্তঃপাঠ্যতা', এবং ইংরেজি সাহিত্যে 'ঐক্য'-এর মতো বিভিন্ন শিরোনামে একটি অধ্যায়ের আয়াত মধ্যে পাঠ্য সম্পর্কের ধারণাটি আলোচনা করা হয়েছে। কুরআনের আয়াতের সমন্বয় সম্পর্কিত দুটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিতে, কুরআনের প্রতিটি অধ্যায়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় রয়েছে এবং এর আয়াতগুলি সম্পর্কিত। দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি কুরআনের কিছু অধ্যায়কে বিষয়গতভাবে সম্পর্কিত নয় এমন অনুচ্ছেদের সংগ্রহ হিসাবে বিবেচনা করে। অধ্যায়গুলি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে, উদাহরণস্বরূপ, অধ্যায় ৯৯, যা মাত্র আটটি আয়াত নিয়ে গঠিত, একচেটিয়াভাবে এস্চ্যাটোলজিতে বা পরকাল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং অধ্যায় ১২ একটি গল্প বর্ণনা করে, যখন অন্যান্য অধ্যায়গুলি, একই নিঃশ্বাসে, ধর্মতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং এথিকো-আইনি বিষয়গুলির কথা বলে। অধ্যায়গুলি কেবল শ্লোক নয়, অনুচ্ছেদগুলি নিয়ে গঠিত বলে জানা যায়। অনুচ্ছেদের মধ্যে সীমানা গুলি স্বেচ্ছাচারী তবে নির্ধারণ করা সম্ভব। যেমন, অধ্যায় ৫৪[১৮] ছয়টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত হতে পারে:[১৯]


ঘন্টা এগিয়ে এসেছে.... (১-৮)

তাদের পূর্বে, নূহের লোকেরা প্রত্যাখ্যান করেছিল... (৯-১৭)

'আদ' প্রত্যাখ্যান করেছে (তাদের বার্তাবাহক)। তাহলে আমাদের প্রতিদান এবং সতর্কীকরণ কতটা (কঠোর) হয়েছে... (১৮-২২)

'সামুদ' সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান করেছে... (২৩-৩২)

'লুত'-এর লোকেরা এই সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান করেছে... (৩৩-৪০)

আর ফেরাউনের লোকদের কাছে সতর্কবাণী এসেছিল... (৪১-৫৫)

কুরআনে পাঠ্য সম্পর্ক অধ্যয়ন কুরআন অধ্যয়নের ইতিহাসে তুলনামূলকভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে। কুরআনের এই দিকটির প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন বলে জানা যায় প্রথম দিকের কুরআনী দোভাষী হলেন ফখরুদ্দিন আল-রাজি (মৃত্য.১২০৯)। ফখর রাজি বিশ্বাস করতেন যে টেক্সট সম্পর্ক এমন একটি অর্থ যা আয়াতগুলিকে একসাথে সংযুক্ত করে বা মানসিকভাবে তাদের কারণ-প্রভাব বা যুক্তি-পরিণতির মতো যুক্ত করে। তিনি একটি অধ্যায়ের ১ আয়াতকে ২ আয়াত, আয়াত ২ থেকে ৩ ইত্যাদি আয়াতের সাথে যুক্ত করেন এবং ঐতিহ্যবাদী ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেন যদি তারা আয়াতের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বিরোধিতা করে। জারকাশী (মৃত্য.১৩৯২), আরেকটি মধ্যযুগীয় কুরআনগত তাফসিরবিদ, স্বীকার করেছেন যে একটি অধ্যায়ে অন্যান্য আয়াতের সাথে কিছু আয়াতের সম্পর্ক কখনও কখনও ব্যাখ্যা করা কঠিন, সেই ক্ষেত্রে তিনি তাদের শৈলীগত এবং আলঙ্কারিক ফাংশন যেমন পিতামাতা, দৃষ্টান্ত বা ইচ্ছাকৃত বিষয় পরিবর্তনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জারকাশীর লক্ষ্য ছিল কুরআন বোঝার জন্য আন্তঃআয়াত সম্পর্ক বোঝা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তিনি এর সম্পর্ক দেখানোর জন্য একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় মোকাবেলা করার চেষ্টা করেননি।[২০][২১]


সমসাময়িক পণ্ডিতরা কুরআনে সমন্বয়ের ধারণাটি আরও জোরালোভাবে অধ্যয়ন করেছেন এবং ব্যাপকভাবে ভিন্ন মতের। উদাহরণস্বরূপ, হামিদ ফারাহী (মৃত্য. ১৯৩০) এবং রিচার্ড বেল (মৃত্য. ১৯৫২) অধ্যায়ের মধ্যে সমন্বয় সম্পর্কিত বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ফারাহী বিশ্বাস করতেন যে কুরআনের পুরো কাঠামোটি বিষয়গতভাবে সুসংগত, যা বলতে হয়, কুরআনের একটি অধ্যায়ের সমস্ত আয়াত একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত যাতে অধ্যায়ের প্রধান বিষয়বস্তুর জন্ম দেওয়া যায় এবং আবার সমস্ত অধ্যায় একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়ে কুরআনের প্রধান বিষয়বস্তু গঠন করে। ফারাহী অনুসারে, প্রতিটি অধ্যায়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় (উমুদ বা স্তম্ভ) রয়েছে যার চারপাশে আয়াতগুলি আবর্তিত হয়:


কুরআনের প্রতিটি অধ্যায় একটি সুগঠিত একক। এটি কেবল আমাদের পক্ষ থেকে বিবেচনা এবং বিশ্লেষণের অভাব যে তারা অসংলগ্ন এবং অসংলগ্ন বলে মনে হয়... প্রতিটি অধ্যায় তার কেন্দ্রীয় থিম হিসাবে একটি নির্দিষ্ট বার্তা প্রদান করে। এই থিমের সমাপ্তি অধ্যায়ের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। যদি প্রতিটি অধ্যায়ে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে এমন কোন নির্দিষ্ট উপসংহার না থাকত তবে কুরআনকে অধ্যায়ে বিভক্ত করার কোন প্রয়োজন হত না। বরং পুরো কোরআন একটি মাত্র অধ্যায় হবে... আমরা দেখি যে, এক গুচ্ছ আয়াত একত্রে স্থাপন করা হয়েছে এবং তার চারপাশে প্রাচীর স্থাপন করে যেভাবে একটি শহর নির্মিত হয়েছে তার নাম 'সূরা' রাখা হয়েছে। একটি একক প্রাচীরে অবশ্যই একটি মাত্র শহর থাকতে হবে। বিভিন্ন শহরকে ঘিরে প্রাচীরের ব্যবহার কী?....[২২]


এর বিপরীতে, রিচার্ড বেল কুরআন শৈলীকে অসংলগ্ন বলে বর্ণনা করেছেন:


কেবল মাত্র খুব কমই আমরা এতে কোনও বড় দৈর্ঘ্যে টেকসই একীভূত রচনার প্রমাণ পাই... বিশেষ করে মোশি এবং অব্রাহামের কিছু আখ্যান যথেষ্ট দৈর্ঘ্যে চলে, কিন্তু তারা সরাসরি বর্ণনা করার পরিবর্তে পৃথক ঘটনায় পড়ে যায়... পৃথক টুকরোগুলির স্বতন্ত্রতা তবে তাদের ঐক্যের চেয়ে বেশি স্পষ্ট।


আর্থার জে আরবেরি বলেছেন যে অনেক ক্ষেত্রে অধ্যায়, যেহেতু মুসলমানরা প্রথম থেকেই স্বীকৃত হয়েছে, একটি 'যৌগিক' চরিত্রের, যা ব্যাপকভাবে ভিন্ন তারিখে মুহাম্মদের প্রাপ্ত টুকরোগুলি ধরে রেখেছে। তবে তিনি এই 'সত্য' উপেক্ষা করেন এবং প্রতিটি অধ্যায়কে একটি শৈল্পিক সমগ্র হিসাবে দেখেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পরিচিত থিমগুলির একটি ভাণ্ডার পুরো কুরআনের মধ্য দিয়ে চলে এবং প্রতিটি অধ্যায়ে তাদের মধ্যে আরও অনেকগুলির মধ্যে একটি বিস্তৃত রয়েছে।[২৩]


অ্যাঞ্জেলিকা নিউউইর্থ ধারণা করেন যে তাদের কালানুক্রমিক ক্রমের শ্লোকগুলি এমনভাবে আন্তঃসম্পর্কিত যা পরবর্তী শ্লোকগুলি পূর্ববর্তীগুলি ব্যাখ্যা করে। তিনি বিশ্বাস করেন যে মক্কান অধ্যায়গুলি সুসংগত একক।[২৪]


সালওয়া এল-আওয়া তার কাজের লক্ষ্য হচ্ছে ভাষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে কুরআনের পাঠ্য সম্পর্কের সমস্যা এবং একটি অধ্যায়ের আয়াতগুলি যেভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং কুরআনের মোট বার্তার বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা। এল-আওয়া ৩৩ এবং ৭৫ অধ্যায়ের সমন্বয় তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ সরবরাহ করে এবং দেখায় যে এই দুটি অধ্যায় এখানে রয়েছে এবং একটি প্রধান প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক রয়েছে।[২৫][২৬]


গেইতুরী এবং গলফাম বিশ্বাস করেন যে কুরআনের একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে বিষয়ের স্থায়ী পরিবর্তন, অথবা যাকে তারা অ-রৈখিকতা বলে, কুরআনের একটি প্রধান ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, একটি বৈশিষ্ট্য যা কুরআনকে কোনও নির্দিষ্ট 'প্রসঙ্গ' এবং 'সাময়িকতা' এর বাইরে রাখে। কুরআনের জন্য ঘেটুরি এবং গলফামের মতে কোন প্রস্তাবনা নেই, কোন পরিচয় নেই, কোন সূচনা নেই, কোন শেষ নেই, একজন পাঠক পাঠ্যের যে কোন জায়গা থেকে পড়া শুরু করতে পারেন।[২৭]

কুরআন

 কুরআন মজিদ অথবা কুরআ-ন মাজী-দ বা কোরআন (আরবি: القرآن আল্-কুর্'আ-ন্[টী১]) ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, যা আল্লাহর বাণী ।[১] এটিকে আরবি শাস্ত্রীয় সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট রচনা বলে মনে করা হয়।[২][৩][৪][৫] কুরআনকে প্রথমে অধ্যায়ে (আরবিতে সূরা) ভাগ করা হয় এবং অধ্যায়গুলো (সূরা) আয়াতে বিভক্ত করা হয়েছে।


এই কিতাব আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইল এর মাধ্যমে ইসলামিক নবি মুহাম্মাদ এর কাছে মৌখিকভাবে ভাষণ আকারে কুরআনের আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন,[৬][৭] দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে সম্পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়। কুরআনের প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হয় ৬০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর যখন মুহাম্মাদের বয়স ৪০ বছর[৮] এবং অবতরণ শেষ হয় মুহাম্মাদের তিরোধানের বছর অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে।[১][৯][১০] মুসলমানরা বিশ্বাস করে থাকেন কুরআন হচ্ছে মুহাম্মদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অলৌকিক ঘটনা যা তার নবুয়তের প্রমাণস্বরূপ[১১] এবং ঐশ্বরিক বার্তা প্রেরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায় যা আদম থেকে শুরু হয়ে মুহাম্মাদের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তবে সুফিবাদের অনুসারীরা বিশ্বাস করে থাকেন মুহাম্মাদের সকল কর্মকান্ড উম্মতের কাছে বোধগম্য করে তোলার জন্যই কুরআন অবতীর্ণ করা হয়। কুরআনের আয়াতসমূহে কুরআন শব্দটি ৭০ বার এসেছে।[১২]


ইসলামি ইতিহাস অনুসারে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে খণ্ড খণ্ড অংশে এটি ইসলামের নবি মুহাম্মাদের নিকট অবতীর্ণ হয়। ইসলামের অনুসারীরা কুরআনকে একটি পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বলে বিশ্বাস করে। কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা আছে। আয়াত বা পঙ্‌ক্তি সংখ্যা ৬,২৩৬ টি; মতান্তরে ৬,৬৬৬ টি। এটি মূল আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়।[১৩][১৪][১৫][১৬] মুসলিম চিন্তাধারা অনুসারে কুরআন ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশেষ এবং গ্রন্থ অবতরণের এই ধারা ইসলামের প্রথম বাণীবাহক আদম থেকে শুরু হয়। কুরআনে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যার সাথে বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মীয়গ্রন্থের বেশ মিল রয়েছে, অবশ্য অমিলও কম নয়। তবে কুরআনে কোনো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা নেই। ইসলামি ভাষ্যমতে কুরআন অপরিবর্তনীয় এবং এ সম্পর্কে মুসলিমরা কুরআনের সূরা আল-হিজরের (১৫ নং সূরা), ৯ নং আয়াতের কথা উল্লেখ করে থাকে, এবং তা হল:


আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।[১৭]


কুরআন এর পাণ্ডুলিপি, ব্রুকলিন যাদুঘর।


ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ১১ শতকের উত্তর আফ্রিকার কুরআন.


ইরানের মাশহাদে কুরআন, যা আলি কৃর্তক লিখিত

ব্যুৎপত্তি ও অর্থ

কুরআনে কুর'আন শব্দটি কয়েকটি অর্থে প্রায় ৭০ বার এসেছে। আর, আরবি ব্যাকরণে 'কুর'আন' শব্দটি একটি 'মাসদার', যা ভাববাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৭৫:১৭,১৮ আয়াতে এটি,(قرأ) ক্বারা'আ ('পাঠ করা', 'আবৃত্তি করা' বা 'অনুসরণ করা') ক্রিয়ার ভাববাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই ক্রিয়াপদটিকেই কুরআন নামের মূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।[১৮] এই শব্দটির মাসদার (الوزن) হচ্ছে غفران তথা গুফরান। এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত ভাব, অধ্যবসায় বা কর্ম সম্পাদনার মধ্যে একাগ্রতা। উদাহরণস্বরুপ, (غفر) নামক ক্রিয়ার অর্থ হচ্ছে 'ক্ষমা করা'; কিন্তু এর আরেকটি মাসদার রয়েছে যার যা হলো (غفران), এই মাসদারটি মূল অর্থের সাথে একত্রিত করলে দাঁড়ায় ক্ষমা করার কর্মে বিশেষ একাগ্রতা বা অতি তৎপর বা অতিরিক্ত ভাব। সেদিক থেকে কুরআন অর্থ কেবল পাঠ করা বা আবৃত্তি করা নয় বরং একাগ্র ভঙ্গীতে পাঠ বা আবৃত্তি করা। কুরআনের মধ্যেও এই অর্থেই কুরআন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনের সূরা আল-কিয়ামাহের (৭৫ নং সূরা) ১৮ নং আয়াতে এই শব্দটি উল্লেখিত আছে:"অতঃপর, আমি যখন তা পাঠ করি (ক্বুরা'নাহু), তখন আপনি সেই পাঠের (কুরআ'নাহ্‌) অনুসরণ করুন।"[১৯]


কুরআনে যেখানেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেই এর যথার্থ বিশেষ্য বা বিশেষণ পাওয়া যায়। ক্বারা'আ ক্রিয়াপদ কুরআনে পুনঃপুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে। ১৭:৯৩ আয়াতে এর অর্থ 'পাঠ করা'; কিন্তু এর বহুল প্রচলিত অর্থটি হল,'আবৃত্তি করা' (তিলাওয়াঃ),৭৫: ১৬,১৭। মুহাম্মাদ-এর আবৃত্তি সমন্ধেও এই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি তাঁর নিজের উপর অবতীর্ণ ওহি আবৃত্তি করেন (৭:২০৪; ১৬:৯৮; ১৭:৪৫; ৮৪:২১; ৮৭:৬)। শব্দটি মুমিনদের আবৃত্তি সমন্ধেও ব্যবহৃত হয়েছে , তারা সালাতে ওহি আবৃত্তি করেন (৭৩:২০)। এ থেকে বোঝা যায়, কুরআন শব্দের অর্থ হল 'আবৃত্তি করা' যা মুহাম্মদ আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত হয়ে আবৃত্তি করেছেন (৭৫:১৮; ৮৬:৬) এবং মানুষের সম্মুখেও আবৃত্তি করেছেন। যদিও কুরআন বলতে সাধারভাবে তাঁর উপর অবতীর্ণ ওহির সমষ্টিকে বুঝায়। তবে শব্দটি (কুরআন) তাঁর উপর অবতীর্ণ পৃথক পৃথক ওহি (১০ঃ১৫; ১২ঃ৩; ৭২ঃ১; ২ঃ১৮৫) সমন্ধে বা খন্ডে খন্ডে অবতীর্ণ (১৭ঃ১০৬; ২০ঃ১; ৭৬ঃ২৩; ২৫ঃ৩২ ; ৫৯ঃ২১) আল্লাহর ওহি সমন্ধে বলা হয়েছে যা তিঁনি আল্লাহ কর্তৃক পেয়েছিলেন (২৭ঃ৬; ২৮ঃ৮৫)।


আল-কিতাব (গ্রন্থ বা পুস্তক) শব্দটি আল-কুরআনের প্রতিশব্দ হিসাবে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। আল-কিতাব সমন্ধে বলা হয়েছে "ইহা এক বরকতময় রাত্রিতে (৪৪:২) অবতীর্ণ হইয়াছে" (৪০:২; ৪৫:২)। ১৫:১ আয়াতে বলা হয়েছে, "এইগুলি আল-কুরআন এবং সুস্পষ্ট অর্থবোধক আল-কিতাবের অলৌকিক নিদর্শনসমূহ।" বিষয়বস্তু হিসেবে কুরআনকে প্রায়ই 'যি'কর' বলা হয়েছে। এখানে এর অর্থ উপদেশ, সাধারণ বাণী (২১:২৬,৪২; ৩৮:৮৭)। যি'করকে 'অবতীর্ণ' (২১:৫০; ৩৮:৮) এবং 'মহান পবিত্র গ্রন্থ' (৪১:৪১) বলা হয়েছে। আবার ৩৬:৬৯ আয়াতে কুরআন সমন্ধে বলা হয়েছে, " এ তো কেবল এক উপদেশ ও স্পষ্ট কুরআন মাত্র"। ২১:৭ আয়াতে আহ্'লুল-কিতাবকে আহ্'লুয যি'কর বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আল-হি'কমাঃ শব্দটি উল্লেখ করা যেতে পারে। ২ঃ১২১,১৫১; ৩ঃ১৬৪; ৬২ঃ২ -এ আল-কিতাবের সাথে হি্'কমাঃ উল্লেখ করা হয়েছে। ২:২৩৯; ৪:১১৩-এ কুরআনের সঙ্গে হিকমতের অবতীর্ণ হওয়ার উল্লেখ আছে। কুরআনে, কুরআনকে "আল-ফুরকা'ন"-ও বলা হয়েছে।


"সূরা(سورة)" শব্দটি আরবি সূর (নগর প্রাচীর) হতে গৃহীত একবচনজ্ঞাপক যোগ করিয়া গঠিত। সূরার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্দিষ্ট অংশকে আয়াত বলা হয়। হিব্রু 'ওত' শব্দের ন্যায় ইহা বিশেষ অর্থে নিদর্শন, বিশ্বাসের নিদর্শন (২ঃ২৪৮; ৩ঃ৪১; ২৬ঃ১৯৭) বিশেষত আল্লাহর অস্তিত্ব ও ক্ষমতার নিদর্শন (১২ঃ১০৫; ৩৬ঃ৩৩) বুঝায়। তাই এটি দ্বারা অলৌকিক ঘটনাকেও (মুজিজা) বুঝায় (৩:৪৯; ৪৩:৪৬)। মুহাম্মদ যে আল্লাহর নবী এর প্রমাণস্বরুপ মক্কার পৌত্তলিকরা তার নিকট অলৌকিক ক্রিয়া (মু'জিযাঃ) দেখানোর দাবী করত। যেহেতু প্রেরিত ওহিগুলোই তার অন্যতম মু'জিযাঃ (৬:১৫৮; ৭:২০৩; ২০:১৩৩; ২৯:৫০) সেজন্যই এগুলোর নাম আয়াত হয়েছে। আয়াতগুলো উর্ধ-জগত হতে (২:৯৯; ২৮:৮৭) আল্লাহর নবীর নিকট (২:২৫২; ৩:৫৮; ৪৫:৫) পাঠানো হত এবং পূর্ববর্তী নবীগনের ন্যায় (২৮:৫৯) তিনিও উহা লোকদেরকে আবৃত্তি করে শোনাতেন (২:১৫১; ৩:১৬৪; ৬৫:১১)।


আরও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তাঁর আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা করেন, (২ঃ১৮৭) ; "তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে" (৩:১১৩); "আর কাফিররা ছাড়া আমার আয়াতসমূহকে কেউ অস্বীকার করে না।" (২৯ঃ৪৭)। আবার কিছু যায়গায় গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আয়াতসমূহের প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে। যেমন,"আর আমি এতে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেছি"(২৪ঃ১); "একটি কিতাব যাহা আমি পাঠাইয়াছি, যেন তাহারা ইহার আয়াতগুলি সমন্ধে চিন্তা করিতে পারে" (৩৮ঃ২১); "এগুলো প্রজ্ঞাপূর্ণ কিতাবের আয়াত" (১০ঃ১; ৩১ঃ১) ; "এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত" (১২ঃ১; ২৬ঃ১; ২৮ঃ১) ; "এ হল কিতাব ও সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াতসমূহ" (১৫ঃ১) ; "এইগুলি আল-কু'রআন ও স্পষ্ট বিবরণদানকারী" (কিতাব) (২৭ঃ১)। "একটি কিতাব যার আয়াতগুলি দৃড়রূপে প্রথিত ", (১১ঃ১, ১৩,১)। কিতাবে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ এবং বিভিন্ন অর্থবোধক আয়াতসমূহ আছে (৩ঃ৭)। যেমন, "আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত আনয়ন করি


" (২ঃ১০৬)। "যদি আমি এক আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা বদল করি (১৬ঃ১০১)।


এইসব বিবরণ হতে মুহাম্মদ (সা.) এর উপর অবতীর্ণ ওহীর বিষয়বস্তু সমন্ধে জানা যায় "উহা সুরক্ষিত ফলক বা লাওহে মাহ্'ফুজ' হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে" (৮৫ঃ২২)। " ইহা একটি সুরক্ষিত পুস্তকে রহিয়াছে" (৫৬ঃ৭৯)। "ইহা আমার নিকট মূল কিতাবে রহিয়াছে" (৪৩ঃ৪; ৩ঃ৭)। আল-কুরআন সমন্ধে বলা হয়েছে, "ইহা একটি উপদেশ-গ্রন্থ যাহা সম্মানিত, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং পবিত্র পত্রসমূহে মহান ন্যায়নিষ্ঠ লেখকদের হস্তে লিপিবদ্ধ" (৮০; ১১-১৬)। ৫২ঃ৮২ আয়াতে বিস্তারিত পত্রে লিখিত কিতাবের শপথ করা হয়েছে এবং ৬৮ঃ১ -এ বলা হয়েছেঃ "কলম ও যাহা দ্বারা লেখা হয় তাহার শপথ" এবং ৯৬ঃ৪-৫ এ বলা হয়েছে "কলম দ্বারা তিনি মানবকে শিক্ষা দিয়েছেন যাহা সে জানিত না" তাঁকে আরও বলা হয়েছে, "তোমার রাব্ব- এর কিতাব হইতে যাহা তোমার প্রতি ওয়াহ্'য়িরূপে পাঠানো হইয়াছে তাহা পাঠ কর"। "আল্লাহর কথা কেহ পরিবর্তন করিতে পারে না " (১৮ঃ২৭)। ৪ঃ১৬৪; ৪০ঃ৭৮ - এ বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁহাকে কতক নবীর কথা বলিয়াছেন এবং কতক নবীর কথা বলেন নাই।


রাসূল এর উপর অবতীর্ণ ওহী থেকেই উম্মুল কিতাব (৪৩ঃ৪) এর মূল বিষয়বস্তু ধারণা করে নেয়া যায়। সেগুলো হল, আল্লাহর সত্তা, বিশ্ব সৃষ্টি - বিশেষত মানব সৃজন, ভাল ও মন্দ আত্না-সমূহের সৃষ্টি, শেষ বিচার, জান্নাত,জাহান্নাম, পূর্ববর্তী নবী গনের অভিজ্ঞতা, আল্লাহর ইবাদত ও সামাজিক জীবন সম্বন্ধীয় যাবতীয় আইন-কানুন এবং বিশেষ বিশেষ আইন (৪ঃ১০৩, ১২৭,১৩৮; ৩৩ঃ৬)। বার মাসের উল্লেখ প্রসঙ্গে (৯ঃ৩৬) এবং ২২ঃ৪ -এ শয়তান কর্তৃক মানবকে প্রলুব্ধ করার প্র‍য়াস প্রসঙ্গে বিশ্ব সৃজন-তত্ত্বের আভাষ দেয়া হয়েছে। এমনকি, বিশ্বে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে এবং সংঘটিত হবে তার সব কিছুই ঐ উম্মুল কিতাবে আছে (১০ঃ৬১; ২৭ঃ৭৫; ৩৪ঃ৩; ৬ঃ৩৮,৫৯; ১১ঃ৬; ২০ঃ৫১; ১৭ঃ৫৮)।


কুরআনের অনেকগুলি নামের মধ্যে বিশেষ চারটি নাম হল আল-কুরআন, আল-ফুরকান, আল-কিতাব ও আয-যিক্'র। ‘আল-কুরআন’ নামের অর্থ 'যাহা পঠিত হয়'। এটি বহু আয়াত ও সূরার সংকলন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআনের প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দটি হল ‘ইকরা’-'পাঠকর'। ‘আল-ফুরকান’ নামের অর্থ পার্থক্যকারী, সত্য ও মিথ্যার, আলো ও অন্ধকারের এবং ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্যকারী। ‘আল্-কিতাব’ অর্থ লিখিত গ্রন্থ যা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ‘আয-যিক্'র’ নামের অর্থ উপদেশ যা আল্লাহ্-তা‘আলা স্বীয় বান্দাগণকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের নিমিত্তে দিয়েছেন।


মুসলমানদের মতে এটি আল্লাহর বাণী, যা ইসলামের নবি ও রাসুল মুহাম্মাদের উপর আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়। তাদের মতে এটি একটি মুজিজা বা অলৌকিক গ্রন্থ যা মানব জাতির পথনির্দেশক। মুসলমানদের বিশ্বাস, কুরআনে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে এবং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।[২০]


ইতিহাস

নবীর যুগ

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, হেরা গুহায় অবস্থানকালে মুহাম্মাদের নিকট প্রথম কুরআনের বাণী প্রেরিত হয়। এরপর ২৩ বছর ধরে তার নিকট কুরআনের বাণী প্রেরিত হয়। হাদিস ও মুসলিম ইতিহাস অনুসারে, মুহাম্মাদ মদীনায় হিজরত করে একটি স্বাধীন মুসলিম সম্প্রদায় গঠন করার পর তিনি তাঁর অনেক সাহাবাকে কুরআন তেলাওয়াত ও এর শিক্ষা গ্রহণ করে ছড়িয়ে দিতে আদেশ দেন, যা নিয়মিত অবতীর্ণ হতো। বলা হয় যে, কিছু কুরাইশ যাদেরকে বদর যুদ্ধে বন্দী করা হয়েছিল, তারা কিছু মুসলিমকে তৎকালীন সরল লিখন পদ্ধতি শেখানোর পর তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায়। এইভাবে মুসলমানদের একটি দল ধীরে ধীরে সাক্ষর হয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে, খেজুরের ডাল, হাড় ইত্যাদিতে কুরআনের আয়াত লিখিত হয়। যাইহোক, ৬৩২ সালে মুহাম্মদের মৃত্যুর সময় কুরআন বইয়ের আকারে লিপিবদ্ধ ছিল না।[২১][২২][২৩] আলেমদের মধ্যে এ ব্যাপারে ঐকমত্য আছে যে মুহাম্মাদ নিজে আয়াতগুলো লেখেননি।[২৪]


সংকলন

মুহাম্মাদ এর জীবদ্দশায় তার তত্ত্বাবধানে প্রথম পূর্ণ কুরআন লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এগুলো এক জায়গায় একত্রিত করা হয়নি। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর এর যুগে দ্বাদশ হিজরি সালে ইয়ামামার যুদ্ধ সত্তর জন হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন।এতে হযরত ওমর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি খলিফা আবু বকর কে বলেন,


"এভাবে জিহাদে হাফেজগন শহীদ হতে থাকলে কুরআনের অনেক অংশ বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। অতএব, আপনি কুরআন মাজিদ একত্রে সংকলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।"

প্রথমে আবু বকর রাজি না হলেও ওমর এর অনুরোধে রাজি হন। কুরআন সংরক্ষণের এ দ্বায়িত্ব মুহাম্মাদ এর সময়ের ওহি লেখক সাহাবি যায়েদ ইবনে সাবিত এর উপর প্রদান করা হয়।


যায়েদ ইবনে সাবিত নিজে হাফেজে কুরআন ছিলেন। তিনি কুরআন সংকলন করার ব্যাপারে দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। একটি হলো-কুরআনের আয়াতটি সংশ্লিষ্ট সাহাবা মুখস্থ বলবেন, অপরটি হলো তিনি মুহাম্মাদ এর সময়ে লিখিত ঐ আয়াতটি প্রদর্শন করবেন। তিনি লিখিত ছাড়া কুরআনের আয়াত সত্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করেননি। তিনি বহু যাচাই বাছাই করার পর সাহাবায়ে কেরামের নিকট রক্ষিত মুহাম্মাদ এর জীবদ্দশায় লিখিত বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি থেকে সে সময়ের আবিষ্কৃত বিশেষ কাগজে গ্রন্থাকারে কুরআন লিপিবদ্ধ (যা সউফ নামে পরিচিত[২৫]) করেন। লিপিবদ্ধ কুরআনটি হযরত আবু বকর এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। তার ওফাতের পর এটি হযরত ওমর এর হেফাজতে থাকে। তার শাহাদাতের পর তারই ওসিয়ত অনুসারে কুরআনের এ প্রতিলিপিটি মুহাম্মাদ এর স্ত্রী বিবি হাফসা এর নিকট গচ্ছিত থাকে। তৃতীয় খলিফা উসমান এর যুগে ইসলামি সম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইসলামের এ প্রসারের ফলে বিভিন্ন জাতি ও ভাষাভাষী লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের অনেকেই কুরআনের গঠন পদ্ধতি অনুসরণ করে কুরআনের বিশেষ শব্দ উচ্চারণ করতে পারত না। বিশেষ করে আরমেনিয়া এবং আজারবাইজান যুদ্ধে সমবেত মুসলমানদের কুরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতা দেখে বিশিষ্ট সাহাবি হুযাইফা, খলিফা উসমান কে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি অবিলম্বে এ নিয়ে নেতৃস্থানীয় সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করে চার জন বিশিষ্ট সাহাবা সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন। এ চার জন সাহাবা হচ্ছেন-


যায়েদ ইবনে সাবিত

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর

সাইদ ইবনুল আস

আব্দুর রহমান ইবনে হারিস [২৬]

হযরত উসমান এর উদ্যোগে হিজরি ২৪ সালে শেষবারের মতো কুরআন সংকলনের এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বোর্ড হযরত হাফসা এর নিকট সংরক্ষিত মূল কপিটি সংগ্রহ করেন।[২৭][২৮] উক্ত বোর্ড পূর্বলিখিত প্রতিলিপিটি অনুসরণ করে পাঠ ও উচ্চারনের বিভিন্নতা দূর করার জন্য শুধু কুরাইশি উচ্চারণ ও ভাষায় তার আরও সাতটি প্রতিলিপি প্রস্তুত করেন। বর্ণিত আছে যে, সাতটি প্রতিলিপি তৈরি করে মক্কা, শাম, ইয়েমেন,বাহরাইন, বসরা ও কুফা প্রদেশে একটি করে প্রেরণ করা হয়। আর রাজধানী মদিনাতে একটি কপি খলিফার নিকট সংরক্ষিত রাখা হয়।[২৯] এরপর বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বিক্ষিপ্তভাবে সংরক্ষিত প্রতিলিপিগুলো সকলের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়।[৩০] এভাবে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান রা.-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পবিত্র কুরআন সংকলিত ও বিভিন্ন প্রদেশে প্রেরিত হয় বিধায় তাকে "جمع القرآن " বা কুরআন সংগ্রহকারী বলা হয়।


ইসলামে গুরুত্ব

অননুকরণীয়তা

মূল নিবন্ধ: কুরআনের অলৌকিকতা

ইসলামী পরিভাষা অনুযায়ী, কুরআনের অলৌকিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এই বিশ্বাসকে ইজায বলা হয়। মুসলমানরা বিশ্বাস করে আল কুরআন একটি ঐশ্বিক গ্রন্থ যা কোনো মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয় ও যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত কার্যকর এবং এর মাধ্যমে এই গ্রন্থ মুহাম্মাদের নবীত্বের মর্যাদার অনুমোদনে প্রদত্ত মূল প্রমাণ। কুরআনেই অননুকরণীয়তা ধারণাটির উৎপত্তি, যেখানে পাঁচটি ভিন্ন আয়াতে এর বিরোধীদের কুরআনের মত কিছু তৈরী করতে আহ্বান করা হয়: "যদি এই কুরআনের অনুরূপ কুরআন রচনা করার জন্য মানুষ ও জ্বীন সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ কুরআন রচনা করতে পারবেনা।"[৩১] নবম শতাব্দী থেকে অসংখ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে যাতে কুরআন ও এর শৈলী ও বিষয়বস্তু নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে। আল জুরজানি (মৃত্যু ১০৭৮) ও আল বাকিলানি (মৃত্যু ১০১৩) সহ মধ্যযুগীয় মুসলিম পণ্ডিতেরা এই বিষয়ে লিখেছেন, এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং কুরআন অধ্যয়নের জন্য ভাষাগত পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও অন্যরা বলেছেন যে কুরআনে মহৎ ধারণা আছে, অন্তর্নিহিত অর্থ আছে, এই গ্রন্থ যুগ যুগ ধরে এর সতেজতা বজায় রেখেছে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং ইতিহাসে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কিছু পণ্ডিত বলেন যে কুরআনে বৈজ্ঞানিক তথ্য আছে যা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কুরআনের অলৌকিকতার মতবাদ প্রমাণে মুহাম্মাদের নিরক্ষরতার উপর আরও জোর দেওয়া হয় যেহেতু নিরক্ষর মুহাম্মাদের পক্ষে এই গ্রন্থ রচনা মোটেই সম্ভব নয়।[৩২][৩৩]


নামাজে কুরআন তেলাওয়াত

নামাজে বিশুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা আবশ্যক। নামাজে কিরাআত তিলাওয়াতের বিষয়াবলী জানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব। ফরজ নামাজের প্রথম দুই রাকাআতে সুরা ফাতিহার সঙ্গে সুরা মিলানো ওয়াজিব। কমপক্ষে তিন আয়াত বা তিন আয়াতের সমপরিমাণ বড় এক আয়াত তিলাওয়াত করতে হবে।


ইসলামী শিল্পকলায়

এছাড়াও কুরআন ইসলামী শিল্প ও বিশেষ করে তথাকথিত কুরআনী চারুলিপি ও চিত্রায়নের পদ্ধতিকে অনুপ্রাণিত করেছে।[৩৪] কুরআনে কখনোই চিত্র ব্যবহার করা হয়নি তবে অনেক কুরআনে পাতার প্রান্তে, সূরার মাঝখানে বা শুরুতে বিভিন্ন ধাঁচে অলঙ্করণ করে সজ্জিত করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনা, মসজিদের বাতি, ধাতব বা মৃৎপাত্রে কুরআনের আয়াত মুদ্রিত হয়েছে।


চারুলিপি, অষ্টাদশ শতাব্দী, ব্রুকলিন যাদুঘর

চারুলিপি, অষ্টাদশ শতাব্দী, ব্রুকলিন যাদুঘর

 

কুরআনী শিলালিপি, বড় গম্বুজ মসজিদ, দিল্লী, ভারত

কুরআনী শিলালিপি, বড় গম্বুজ মসজিদ, দিল্লী, ভারত

 

সূরা আন-নূর এর আয়াত সম্বলিত এনামেল কাঁচের মসজিদ প্রদীপ

সূরা আন-নূর এর আয়াত সম্বলিত এনামেল কাঁচের মসজিদ প্রদীপ

 

কুরআনের আয়াত সম্বলিত দেয়াল, শাহ-ই-জিন্দা স্মৃতিসৌধ, সমরকন্দ, উজবেকিস্তান

কুরআনের আয়াত সম্বলিত দেয়াল, শাহ-ই-জিন্দা স্মৃতিসৌধ, সমরকন্দ, উজবেকিস্তান

 

কুরআন এর পৃষ্ঠা সজ্জা, উসমানীয় যুগ

কুরআন এর পৃষ্ঠা সজ্জা, উসমানীয় যুগ

 

স্বর্ণে লিখিত এবং বাদামী কালি দিয়ে অঙ্কিত কুরআনের এই পাতাগুলো অনুভূমিক বিন্যাসে সজ্জিত। এটি কুফিক লিপির একটি নিদর্শন।

স্বর্ণে লিখিত এবং বাদামী কালি দিয়ে অঙ্কিত কুরআনের এই পাতাগুলো অনুভূমিক বিন্যাসে সজ্জিত। এটি কুফিক লিপির একটি নিদর্শন।

পাঠ্য ও বিন্যাস

মূল নিবন্ধসমূহ: কুরআনের পারা ও সূরা


সূরা আল-ফাতিহা, কুরআন এর প্রথম সূরা।


কুরআনের নাযিল হওয়া প্রথম চার আয়াত; ৯৬তম সূরা আলাক

কুরআনে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের মোট ১১৪টি সূরা রয়েছে। সকল সূরা মিলিয়ে মোট আয়াতের (আয়াত আরবি শব্দ, এর সাহিত্যিক অর্থ নিদর্শন) সংখ্যা প্রায় ৬,২৩৬ (মতান্তরে ৬৩৪৮টি অথবা ৬৬৬৬টি)।[৩৫] প্রত্যেকটি সূরার একটি নাম রয়েছে। নামকরণ বিভিন্ন উপায়ে করা হয়েছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত কোনো শব্দকেই নাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া এমন নামও পাওয়া যায় যা সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয় নি যেমন সূরা ফাতিহা। ফাতিহা শব্দটি এ সূরার কোথাও নেই। সূরাগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট সজ্জা রয়েছে। সজ্জাকরণ তাদের অবতরণের ধারাবাহিকতা অনুসারে করা হয় নি। বরং দেখা যায় অনেকটা বড় থেকে ছোট সূরা অনুযায়ী সাজানো। অবশ্য একথাও পুরোপুরি সঠিক নয়। সজ্জার প্রকৃত কারণ কারও জানা নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় সূরাও ছোট সূরার পরে এসেছে। তবে একটি সূরা বা তার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ধারাবাহিকতার সাথেই অবতীর্ণ হয়েছিল বলে মুসলমানদের ধারণা। কুরআনের সজ্জাটি মানুষের মুখস্থকরণের সুবিধার সৃষ্টি করেছে।


হিজ্‌ব বা মানজিল হচ্ছে কুরআনের প্রথম সূরা (সূরা ফাতিহা) ব্যতীত অন্য সূরাগুলো নিয়ে করা একটি শ্রেণি। হিজ্‌ব মুফাস্‌সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করা। এতে ৭টি মানজিলের মাধ্যমে সবগুলো সূরাকে একসাথে করা হয়েছে।[৩৬] মানজিলগুলো হচ্ছে:


মানজিল ১ = ৩ টি সূরা, যথা, ২—৪

মানজিল ২ = ৫ টি সূরা, যথা, ৫—৯

মানজিল ৩ = ৭ টি সূরা, যথা, ১০—১৬

মানজিল ৪ = ৯ টি সূরা, যথা, ১৭—২৫

মানজিল ৫ = ১১ টি সূরা, যথা, ২৬—৩৬

মানজিল ৬ = ১৩ টি সূরা, যথা, ৩৭—৪৯

মানজিল ৭ = ৬৫ টি সূরা, যথা, ৫০—১১৪

কুরআনে মোট ৩০ টি পারা বা অধ্যায় রয়েছে। ১১৪টি পূর্নাঙ্গ সূরা রয়েছে। সূরাগুলো বিভিন্ন আকারের হলেও কুরআনের পারাগুলো প্রায় সমান আকারের। কুরআন মুখস্থকরণের ক্ষেত্রে সাধারণতম পারা অনুযায়ী শিক্ষা করানো হয়। যে সকল স্থানে সমগ্র কুরআন পাঠের আয়োজন করা হয় সেখানেও এই পারা অনুযায়ী করা হয়।


বিষয়বস্তু

কুরআনের বিষয়বস্তু আল্লাহর অস্তিত্ব এবং পুনরুত্থান সহ মৌলিক ইসলামী বিশ্বাসসমূহ বর্ণনা করে। পূর্বের নবিগণের বিবরণ, নৈতিক ও আইনগত বিষয়, মুহাম্মাদের সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনা, দানশীলতা ও নামাজের কাহিনীও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনের আয়াতে ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে সাধারণ উপদেশ রয়েছে এবং এতে বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সাধারণ নৈতিক পাঠের রূপরেখা প্রদান করে। প্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে মুসলিমরা কুরআন এর বার্তার সত্যতার ইঙ্গিত হিসাবে ব্যাখ্যা করে।[৩৭]


একেশ্বরবাদ

কুরআনের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো একেশ্বরবাদ। আল্লাহ জীবন্ত, শাশ্বত, সর্বব্যাপী এবং সর্বশক্তিমান হিসেবে বর্ণিত (দেখুন কুরআন ২:২০, ২:২৯, ২:২৫৫)। আল্লাহর শক্তিমত্তা তার সৃষ্টির ক্ষমতায় সর্বোপরি আবির্ভূত হয়। তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর স্রষ্টা (দেখুন কুরআন ১৩:১৬, ২:২৫৩, ৫০:৩৮ ইত্যাদি)। কুরআন এর মতে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতার দিক দিয়ে সকল মানুষ সমান এবং এই সত্যকে স্বীকার করা ও তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত।


কুরআনে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বিভিন্ন আয়াতে সৃষ্টিতাত্ত্বিক যুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ,মহাবিশ্ব প্রবর্তিত হয়েছে সুতরাং এর একজন প্রবর্তক প্রয়োজন এবং যা কিছু বিদ্যমান, সবকিছুর অস্তিত্বের জন্যই একটি যথার্থ কারণ থাকতে হবে। এছাড়া, এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের কথাও প্রায়ই উল্লেখ করা হয়েছে: "যিনি সাত আসমান স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোন অসামঞ্জস্য দেখতে পাবে না। তুমি আবার দৃষ্টি ফিরাও, কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি?"[৩৮][৩৯]


পরলোকতত্ত্ব

নবী-রাসুল

কুরআন এ উল্লেখিত নবী-রাসুলগণ হলেন


আদম

নূহ

ইদ্রিস

হুদ

সালেহ

ইব্রাহিম

ইসমাইল

ইসহাক

লুত

ইয়াকুব

ইউসুফ

শোয়াইব

মুসা

হারুন

ইলিয়াস

আল ইয়াসা

দাউদ

সোলাইমান

আইয়ুব

ইউনুস

যুল কিফ্‌ল

যাকারিয়া

ইয়াহিয়া

ঈসা

মুহাম্মদ

নৈতিকতাত্ত্বিক ধারণা

বিজ্ঞানের জন্য উৎসাহ

সাহিত্যিক গঠন

কুরান

ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্য এবং ইসলাম শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ইসা বাউলাতা কুরআনের সাহিত্যিক গঠনপ্রণালি সম্বন্ধে নিম্ন প্রকারের মন্তব্য করেছেন।[৪০]


কুরআনের বার্তাগুলো বিভিন্ন সাহিত্যিক গঠনে প্রকাশিত হয়েছে, যা আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে নিখুঁত লিখিত রচনা হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কুরআনের ভাষার উপর ভিত্তি করেই আরবি ব্যাকরণ রচিত হয়েছে, এবং মুসলিম অলঙ্কার শাস্ত্রবিদদের বর্ণনামতে, কুরআনের বাগধারাগুলো ভীষণ সুন্দর এবং মহিমান্বিত হিসেবে বিবেচিত হয়... উপসংহারে একথা বলা যেতে পারে যে, কুরআন এর বার্তা প্রকাশ করার নিমিত্তে বিপুল প্রকার ও শ্রেণির সাহিত্যিক উপাদানের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছে।

কুরআনের ব্যাখ্যা কোরআন নিজেই দেয়।


ব্যাখ্যা

কুরআনের আয়াতের অর্থ, ব্যাখ্যা এবং তাদের তাৎপর্য খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে যাকে তাফসীর বলা হয়। তাফসীর মুসলিমদের প্রাচীনতম কেতাবি কার্যক্রমগুলির একটি। কুরআন অনুসারে, মুহাম্মাদ প্রথম ব্যক্তি যিনি মুসলমানদের জন্য আয়াতের অর্থ বর্ণনা করেন।[৪১] অন্যান্য প্রারম্ভিক দৃষ্টান্তের মধ্যে কয়েকজন সাহাবা যেমন আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান ইবন আফফান, আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, উবাই ইবনে কাব, জায়েদ ইবনে সাবিত, আবু মুসা আশয়ারী এবং আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের।[৪২] সে সময় ব্যাখ্যা-পদ্ধতি, আয়াতের সাহিত্যিক দিকগুলির ব্যাখ্যা, এর শানে নুযূল এবং মাঝে মাঝে অন্য আয়াতের সাহায্যে কোনো আয়াতের ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যদি আয়াতটি কোন ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধীয় হয়, তাহলে কখনও কখনও মুহাম্মাদ এর কিছু হাদিস বর্ণনা করে এর অর্থ স্পষ্ট করা হতো।[৪৩]


যেহেতু কুরআন ধ্রুপদী আরবী ভাষায় উচ্চারিত হয়, পরবর্তী ধর্মান্তরিতদের অনেকেই (অধিকাংশই অ-আরব) সবসময় কুরআন এর আরবি বুঝতো না, আরবী ভাষায় সাবলীল ব্যক্তির কাছে যেসব অভিব্যক্তি সুস্পষ্ট তা তারা বুঝতে সক্ষম ছিলো না। আরবী ভাষার ভাষ্যকাররা এই অভিব্যক্তিগুলো ব্যাখ্যা করেছেন এবং মুহাম্মাদের নবীত্বের শুরুতে কোন আয়াতগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যা প্রাচীনতম মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য উপযুক্ত, এবং কোনগুলো পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে তা চিহ্নিত করেছেন, এর ভিত্তিতে পুরাতন পাঠ্যগুলো (মানসুখ) বাতিল (নাসিখ) করা হয়েছে।[৪৪][৪৫] তবে অন্যান্য কিছু আলেমগণ মনে করেন যে কুরআনের কোন আয়াত বাতিল করা হয়নি।[৪৬]


বিভিন্ন আলেমদের দ্বারা কুরআনের বেশ কিছু ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে। জনপ্রিয় কয়েকটি হলো তাফসির ইবনে কাসির, তাফসির আল জালালাইন, তাফহিমুল কুরআনতাফসির আল-তাবারি, তাফসির আল কবির। তাফসীরের আরও আধুনিক কাজ হলো মাআরিফুল কুরআন।


গূঢ় ব্যাখ্যা

সুফি ধারাভাষ্যের ইতিহাস

অর্থের স্তর

পুনঃগ্রাস

অনুবাদের ইতিহাস

মূল নিবন্ধ: কুরআন অনুবাদ

আরও দেখুন: কুরআনের অনুবাদসমূহের তালিকা

কুরআন অনুবাদ করা সবসময়ই সমস্যাজনক এবং জটিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। অনেকে বলেন যে কুরআনের পাঠ্য অন্য ভাষায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়।[৪৭] উপরন্তু, প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে একটি আরবি শব্দের বিভিন্ন অর্থ থাকতে পারে, যা একটি যথাযথ অনুবাদ প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে আরও কঠিন করে তোলে।[৪৮]


তা সত্ত্বেও, কুরআন অধিকাংশ আফ্রিকান, এশীয় এবং ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে।[৩২] ইসলামের প্রথম যুগে, সপ্তম শতাব্দীতে, সালমান আল-ফারসি সূরা ফাতিহাকে ফারসি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কুরআন অনুবাদের সূচনা করেন।[৪৯] ইতোপূর্বে মুহাম্মাদ, আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশী বা নিগাস ও বাইজেন্টাইনের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠানো চিঠিতে কুরআনের আংশিক অনুবাদ প্রেরণ করেন।[৪৮] হিন্দু রাজা মেহরুকের অনুরোধে আবদুল্লাহ বিন উমর বিন আব্দুল আজিজের নির্দেশে ৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে আলওয়ারে (সিন্ধু, ভারত, বর্তমানে পাকিস্তান) ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের জন্য কুরআনের আরেকটি অনুবাদ সম্পন্ন হয়।[৫০]


কুরআনের প্রথম সম্পূর্ণ অনুবাদ ফার্সি ভাষায় ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। সামানি সম্রাট প্রথম মনসুরের শাসনামলে (৯৬১-৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ), তার উদ্যোগে, খোরাসানের একদল পণ্ডিত আরবী ভাষায় লিখিত তাফসির আল-তাবারী কে ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে একাদশ শতাব্দীতে আবু মনসুর আব্দুল্লাহ আল-আনসারির একজন ছাত্র ফার্সি ভাষায় কুরআনের একটি সম্পূর্ণ তাফসীর লেখেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে, নাজম আল-দীন আবু হাফস আল-নাসাফি ফার্সি ভাষায় কুরআন অনুবাদ করেন। তিনটি বইয়ের পাণ্ডুলিপিই পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার প্রকাশিত হয়েছে।


১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১০২ টি ভাষায় কুরআন অনুবাদিত হয়েছিল।[৪৮] বর্তমানে পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলোর প্রায় সবগুলোতেই কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ রয়েছে। ২০১০ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ১৮তম আন্তর্জাতিক কুরআন প্রদর্শনীতে ১১২টি ভাষায় অনুবাদিত কুরআন উপস্থাপিত হয়।[৫১]


১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে পিটার দ্য ভেনারেবল এর জন্য লাতিন ভাষায় রবার্ট কেটন এর করা কুরআন এর অনুবাদটি পাশ্চাত্য ভাষায় কুরআন এর প্রথম অনুবাদ ছিল।[৫২] ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি ভাষায় আন্দ্রে দু রায়ার এর অনুবাদটি ব্যবহার করে ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে আলেকজানডার রস্‌ কুরআনের প্রথম ইংরেজী অনুবাদটি সম্পন্ন করেন। ১৭৩৪ সালে জর্জ সেল কুরআনের প্রথম পাণ্ডিত্যপূর্ণ অনুবাদ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন; আরেকটি ১৯৩৭ সালে রিচার্ড বেল কর্তৃক এবং আরও একটি ১৯৫৫ সালে আর্থার জন আর্বেরি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই সকল অনুবাদকেরাই অমুসলিম ছিলেন। মুসলিমদের দ্বারাও ইংরেজিতে কুরআন অনুবাদিত হয়েছে। আধুনিক ইংরেজিতে মুসলিম অনুবাদকদের প্রকাশিত কুরআন এর মধ্যে রয়েছে দ্য অক্সফোর্ড ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক কর্তৃক প্রকাশিত মুহাম্মাদ আবদেল হালিম এর অনুবাদ, ড. মুস্তাফা খাত্তাব এর অনুবাদ দ্য ক্লিয়ার কুরআন, সহিহ ইন্টারন্যাশনাল অনুবাদ ইত্যাদি।


পাঞ্জাবের মোগা জেলায় কুরআন এর প্রাচীনতম গুরমুখী অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে, যা ১৯১১ সালে মুদ্রিত হয়েছিল।[৫৩]


আন্তঃরৈখিক ফার্সি অনুবাদসহ ইলখানাত যুগের আরবী কুরআন।

আন্তঃরৈখিক ফার্সি অনুবাদসহ ইলখানাত যুগের আরবী কুরআন।

 

১৬৪৭ সালে ইউরোপীয় ভাষায় প্রথম মুদ্রিত কুরআন।

১৬৪৭ সালে ইউরোপীয় ভাষায় প্রথম মুদ্রিত কুরআন।

 

জার্মান ভাষায় কুরআন এর প্রথম অনুবাদের নামপত্র।

জার্মান ভাষায় কুরআন এর প্রথম অনুবাদের নামপত্র।

 

চীনা ভাষায় কুরআন এর অনুবাদে সূরা ইয়াসীনের আয়াত ৩৩ ও ৩৪।

চীনা ভাষায় কুরআন এর অনুবাদে সূরা ইয়াসীনের আয়াত ৩৩ ও ৩৪।

বাংলা ভাষায় কুরআনের প্রধান অনুবাদসমূহ

গিরিশ চন্দ্র সেন (বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদ);

আব্বাস আলী(বাংলা ভাষার প্রথম পূর্নাঙ্গ মুসলিম অনুবাদক)

মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা;

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ;

বিচারপতি হাবিবুর রহমান;

আহমদ রেজা খান বেরলভী (উর্দু ভাষা)

পঠন

পঠনের নিয়ম

আরও দেখুন: তাজবিদ

কুরআনের যথাযথ তেলাওয়াত হলো তাজবিদ নামের একটি পৃথক শৃঙ্খলার বিষয় যা কীভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত, প্রতিটি স্বতন্ত্র বর্ণনামূলক উচ্চারণ কীভাবে করা উচিত, যে স্থানে বিরতি থাকা উচিত সেখানে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন, উচ্চারণের ক্ষেত্রে যেখানে উচ্চারণটি দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত, যেখানে বর্ণগুলি এক সাথে শোনা উচিত এবং যেখানে সেগুলি পৃথক রাখা উচিত ইত্যাদি বিষয়গুলি বিশদভাবে নির্ধারণ করে। বলা যেতে পারে যে, এই অনুশাসনটি কুরআনের সঠিক তেলাওয়াতের আইন ও পদ্ধতিগুলি অধ্যয়ন করে এবং তিনটি মূল ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে: ব্যঞ্জনধ্বনি এবং স্বরধ্বনির যথাযথ উচ্চারণ (কুরআনীয় ধ্বনির উচ্চারণ), আবৃত্তিতে বিরতি দেওয়ার নিয়ম এবং পুনরায় শুরুকরণের নিয়ম, এবং আবৃত্তির বাদ্যযন্ত্র এবং সুমধুর বৈশিষ্ট্য।[৫৪]


কুরআনের ভুল তেলাওয়াত এড়াতে, তেলাওয়াতকারীরা একজন উপযুক্ত শিক্ষকের সাথে প্রশিক্ষণের একটি প্রোগ্রাম অনুসরণ করেন। তাজবিদ বিধিগুলির জন্য উল্লেখ হিসাবে ব্যবহৃত দুটি জনপ্রিয় গ্রন্থ হলো ইবনে আল-জাজারি রচিত মাতন আল-জাজারিয়াহ[৫৫] এবং সুলায়মান আল জামজুরি রচিত তুহফাত আল-আতফাল।


এল মিনশাবি, আল-হুসারি, আবদুল বাসিত, মোস্তফা ইসমাইল এর মতো কয়েকজন মিশরীয় তেলাওয়াতকারীর তেলাওয়াত, তেলাওয়াতের বর্তমান শৈলীর বিকাশে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল।[৫৬][৫৭][৫৮][৫৯]:৮৩ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশ্ব-স্তরের তেলাওয়াতের জন্য সুপরিচিত, যা প্রমাণিত হয়েছে জাকার্তার মারিয়া উলফাহ এর মতো মহিলা তেলাওয়াতকারীদের জনপ্রিয়তায়।[৫৪]


তেলাওয়াত দুই প্রকার:


মুরাত্তাল, যা ধীর গতিতে, অধ্যয়ন এবং অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

মুজাওয়াদ, একটি ধীর তিলাওয়াতকে বোঝায় যা প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের দ্বারা জনসাধারণের পরিবেশনার মতো উচ্চতর প্রযুক্তিগত শৈল্পিকতা এবং সুরেলা মড্যুলেশন স্থাপন করে।[৬০]

বৈকল্পিক পাঠ

লিখন ও মুদ্রণ

লিখন

১৯ শতকে ব্যাপকভাবে মুদ্রণ প্রচলিত হওয়ার পূর্বে, কুরআন ক্যালিগ্রাফার ও অনুলিপিকারীদের তৈরিকৃত অনুলিপির মাধ্যমেই হস্তান্তরিত হতো। প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিগুলো হেজাজি লিপিতে লেখা হয়েছিল। হেজাজি শৈলীর পাণ্ডুলিপি অন্তত এটা নিশ্চিত করে যে লিখিতভাবে কোরআন এর প্রসার প্রাথমিক পর্যায়েই শুরু হয়েছিল। সম্ভবত নবম শতাব্দীতে, লেখাগুলোতে পুরু রেখার ব্যবহার শুরু হয়, যা ঐতিহ্যগতভাবে কুফিক লিপি নামে পরিচিত। নবম শতাব্দীর শেষের দিকে, কুরআনের অনুলিপিগুলোতে নতুন ধরনের লিপি আবির্ভূত হতে শুরু করে যা পূর্ববর্তী লিপিকে প্রতিস্থাপন করে। পূর্ববর্তী শৈলীর ব্যবহার বন্ধ করার কারণ ছিল যে, ঐ পদ্ধতিতে অনুলিপি তৈরী করতে অনেক সময় লাগতো কিন্তু সেসময় অনুলিপির চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছিল। অনুলিপিকারীরা তাই লেখার সহজ শৈলীটিই বেছে নেয়। একাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে, ব্যবহৃত শৈলী ছিল প্রাথমিকভাবে নাসখ, মুহাক্কাক, রায়হানি এবং কিছু বিরল ক্ষেত্রে সুলুস লিপি। নাসখ খুব ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকা এবং ইবেরিয়াতে, মাগরিবি শৈলী অধিক জনপ্রিয় ছিল। আরও স্বতন্ত্র হলো বিহারী লিপি যা শুধুমাত্র ভারতের উত্তরাঞ্চলেই ব্যবহৃত হয়েছিল। নাস্তালিক শৈলী ফার্সি বিশ্বে খুব কমই ব্যবহৃত হয়।[৬১][৬২]


শুরুতে, কুরআন বিন্দু বা হরকত সহ লেখা হতো না। এই বৈশিষ্ট্য সর্বশেষ সাহাবাহদের জীবদ্দশার শেষ পর্যায়ে যোগ করা হয়। যেহেতু অধিকাংশ মুসলিমদের জন্যই পাণ্ডুলিপি কেনা খুবই ব্যয়বহুল ছিল, তাই কুরআনের কপিগুলো মসজিদে রাখা হতো যাতে তা জনগণের কাছে সুলভ হয়। উৎপাদনশীলতার দিক থেকে, উসমানীয় অনুলিপিকারীরাই সর্বোত্তম নিদর্শন তৈরী করে। এর কারণ ছিল ব্যাপক চাহিদা, মুদ্রণ পদ্ধতির অজনপ্রিয়তা এবং নান্দনিকতা।[৬৩][৬৪]


"নীল" কুরআন এর একটি পৃষ্ঠা

"নীল" কুরআন এর একটি পৃষ্ঠা

 

কুফিক লিপি, অষ্টম বা নবম শতাব্দী।

কুফিক লিপি, অষ্টম বা নবম শতাব্দী।

 

মাগরিবি লিপি, ১৩-১৪শ শতাব্দী

মাগরিবি লিপি, ১৩-১৪শ শতাব্দী

 

মুহাক্কাক লিপি, চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী।

মুহাক্কাক লিপি, চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী।

 

শিকাস্তা নাস্তালিক লিপি, ১৮-১৯শ শতাব্দী।

শিকাস্তা নাস্তালিক লিপি, ১৮-১৯শ শতাব্দী।

মুদ্রণ

অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে সম্পর্ক


রানী বিলকিসের ‘রাজা সুলাইমানের কাছে সফর’। এডওয়ার্ড পয়েন্টার, ১৮৯০। তাওরাতের মতে, সুলাইমান ছিলেন একজন রাজা, যার সাতশত স্ত্রী এবং তিনশত উপ-পত্নী তার বৃদ্ধ বয়সে পথভ্রষ্ট হয় এবং মূর্তি পূজা শুরু করে[৬৫]। তাকে কুরআনে একজন রাজা-নবী-শাসক ও জ্বিন এবং প্রকৃতির শাসক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিছু অমুসলিম দল যেমন বাহাই এবং দ্রুজরা কোরআনকে পবিত্র মনে করে। একেশ্বর সার্বজনীনবাদীরাও কুরআন থেকে অনুপ্রেরণা চাইতে পারেন। কুরআনের সাথে ডায়াতেসারন, জেমসের প্রোটোয়েভেঞ্জেলিয়াম, ইনফ্যান্সি গসপেল অব থমাস, স্যুডো-ম্যাথিউ গসপেল এবং আরবী ইনফ্যান্সি গসপেলের সাথে কিছু আখ্যানের মিল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।[৬৬][৬৭][৬৮] একজন পণ্ডিত পরামর্শ দিয়েছেন যে একটি গসপেল হারমনি হিসেবে ডায়াতেসারনকে ক্রিশ্চিয়ান গসপেলের একটি পাঠ্য হিসেবে ধারণা করা হয়েছে।[৬৯]


বাইবেল

তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যা পূর্ববর্তী বিষয়ের সত্যতা প্রতিপাদনকারী এবং এর পূর্বে তাওরাত ও ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেছিলেন।[৭০]


কুরআনে পূর্বের কিতাবগুলোর (তওরাত ও ইঞ্জিল) সাথে তার সম্পর্ককে তাদের অনন্য উৎপত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে এগুলো সবই এক আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ হয়েছে।[৭১]


ক্রিস্টোফ লাক্সেনবার্গের (দ্য সিরো-আরামাইক রিডিং অব দ্য কোরান বইয়ে) মতে কুরআনের ভাষা সিরিয়াক ভাষার অনুরূপ ছিল। কুরআনে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের পবিত্র বই (তানাক, বাইবেল) এবং ভক্তিমূলক সাহিত্যে বর্ণিত অনেক মানুষের কাহিনী এবং ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যদিও এর বিস্তারিত বিবরণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।[৭২] অ্যাডাম, এনোচ, নুহ, ইবার, শেলা, অব্রাহাম, লূত, ইসমাইল, ইস্ হাক, যাকোব, যোষেফ, জেথ্রো, দায়ূদ, শলোমন, এলিয়, ইলীশায়, যোনা, হারোণ, মোশি, জাকারিয়া, বাপ্তিস্মদাতা ও যীশুকে ঈশ্বরের নবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত, কুরআনে অন্য যে কোন ব্যক্তির তুলনায় মূসাকে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।[৭৩] ঈসাকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর চেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয় (মুহাম্মদ নামকে প্রায়ই 'নবি' বা 'রাসুল' বলে উল্লেখ করা হয়), অন্যদিকে মরিয়মকে নতুন টেস্টামেন্টের চেয়ে কুরআনে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।[৭৪]

নদী

 নদী (সমার্থক শব্দ - তটিনী, তরঙ্গিনী, সরিৎ ইত্যাদি) সাধারণত মিষ্টি জলের একটি প্রাকৃতিক জলধারা যা ঝরনাধারা, বরফগলিত স্রোতধারা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট নদী পথ হয়ে প্রবাহ শেষে সাগর, মহাসাগর, হ্রদ বা অন্য কোন নদী বা জলাশয়ে পতিত হয়। মাঝে মাঝে অন্য কোন জলের উৎসের কাছে পৌঁছানোর আগেই নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেতে পারে। নদীকে তার গঠন অনুযায়ী শাখানদী, উপনদী, প্রধান নদী, নদ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যায়। আবার ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ছোট নদীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। সাধারণত নদীর নামকরণ করা হয়েছে মেয়েদের নামে। Marie Morisawa এর মতে নদী হল খালের মধ‍্য দিয়ে প্রবাহিত জলধারা।-River is a canal flow.


নদীর জন্ম ও তাত্ত্বিক ধারণা


গুয়াহাটির শুক্লেশ্বর ঘাট থেকে ব্ৰহ্মপুত্রের দৃশ্য

সাধারণত পর্বত, উঁচু ভূমি, পাহাড়ের গিরিখাত থেকে সৃষ্ট ঝরণাধারা, বরফগলিত স্রোত কিংবা প্রাকৃতিক পরিবর্তন থেকে নদীর জন্ম। হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে আসা জলরাশিতে এক ধরনের প্রচন্ড গতি সঞ্চারিত হয়। ছুটে আসা এই দ্রুত গতিসম্পন্ন জলস্রোত স্থলভাগ অতিক্রম করার সময় নদী নামে পরিচিত হয়। নদী যখন পাহাড়ি এলাকায় ঢালু পথ বেয়ে প্রবাহিত হয় তখন তার যৌবনাবস্থা। এ সময় নদী ব্যাপক খননকাজ চালায় বা ভূমিক্ষয় করে এবং উৎপত্তিস্থল থেকে নুড়ি, পাথর, বালি, খনিজ, পলি প্রভৃতি স্রোতের ধারায় অতি সহজে সমুদ্রে নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে ধাবিত করে। নদী এভাবেই আবহমানকাল ধরে পৃথিবীর পর্বত, পাহাড় ও উচু ভূমি ক্ষয় করে চলেছে। তার এ কাজ শেষ হয় তখন, যখন সমস্ত নদী-অববাহিকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সমভূমি বা প্রায় সমভূমি অঞ্চলে পরিণত হয়। উৎস থেকে মোহানা অবধি নদীর এই কাজকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়।


নদীর যৌবন অবস্থা

এ অবস্থায় নদীর প্রধান কাজ হল ক্ষয় এবং বহন। সাধারণত পার্বত্য অবস্থাটিই নদীর যৌবনকাল। এ সময় নদী বড় বড় পাথর বহন করে নিয়ে আসে। এসব পাথরের ঘর্ষনে নদীর তলদেশ ক্ষয় পেয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়ক্রিয়ার ফলে গিরিখাত, ক্যানিয়ন এবং জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।


নদীর পরিপক্ব অবস্থা

এ অবস্থায় নদী একটু স্তিমিত হয়। ফলে নদীর বেগ ও বোঝা বয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। সাধারণত নদী মধ্যস্থানে বা উপত্যকায় প্রবেশ করলে এই পরিপক্ব বা প্রৌঢ় অবস্থা বোঝায়। এই অবস্থায় গিরিখাত, খরস্রোত, জলপ্রপাত প্রভৃতি আর দেখা যায় না। পাহাড়গুলো এবং তার মধ্যবর্তী জলবিভাজিকার উচ্চতাও আগের চেয়ে কম দেখা যায়।


নদীর বৃদ্ধাবস্থা

এই অবস্থায় নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। তবে ভাঙার কাজ অল্পস্বল্প চলে। সাধারণত সমতল ভূমিতে নদীর এই অবস্থা হয়। এতে কোথাও কোথাও উঁচু ভূমি থাকতে পারে। এ সময় নদীর গতিমাত্রা এত কমে যায় যে, সামান্য বাধা পেলেই নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। নদী এই অংশে খুব এঁকেবেঁকে চলে। পথে পথে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় নদী বর্ষাকালে প্রায়ই দু’কূলে বন্যার সৃষ্টি করে। নদীর পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে বালি ও পলি দুই তীরে ছড়িয়ে পড়ে। নদীর বুকেও চর জাগে। তবে নদী সবসময় ঠিক এভাবে চলে না। মাঝে মাঝে ভূকম্পনের ফলে নদী আবার যৌবন পেতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণেও নদীর তীব্রতা ও গতি বাড়তে পারে।


ভূ-আন্দোলন যদি ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন তা গিরিজনিতে পর্যবাসিত হয়। এর ফলে নতুন নতুন পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে এমন কিছুসংখ্যক বিরল নদী আছে, যারা উত্থিত পর্বতের শক্তিকে পর্যুদস্ত করে তাদের ক্ষয়কার্য অব্যাহত রেখেছে এবং পর্বতরাজির উত্থান সংঘটিত হবার পরও তাদের অস্তিত্ত বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ঐ সমস্ত নদীকে বলা হয় প্রাকভূমিরূপ নদী। উদাহরণস্বরূপ কলরেডো, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্রের নাম বলা যেতে পারে। কলরেডো রকি পর্বতের এবং সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র নদ হিমালয় পর্বতের উজানের অনেক আগে থেকেই সেখানে প্রবহমান ছিল।[১]


নদীর প্রকারভেদ

প্রধান নদী সাধারণত পাহাড় হতে সৃষ্ট ঝরণা, হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হয়, যেমন পদ্মা গঙ্গোত্রী হিমবাহ হতে উৎপন্ন হয়েছে। শাখানদী অন্য কোন নদী হতে উৎপন্ন হয়। যেমন বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীর শাখা নদী। উপনদী সাধারণত অন্য নদীতে গিয়ে মেশে এবং প্রবাহ দান করে, যেমন আত্রাই নদী। কোন প্রধান নদী অন্য নদীর উপনদীও হতে পারে। আবার পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দের ভিত্তিতে এই জলস্রোতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যে সকল জলস্রোতের নাম স্ত্রীবাচক তাদের নদী বলা হয়। এদের নাম দীর্ঘস্বর কারান্ত হয়। যেমনঃ মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, কুশিয়ারা ইত্যাদি। যে সকল জলস্রোতের নাম পুরুষবাচক তাদের বলা হয় নদ। এদের নাম হ্রস্বস্বর কারান্ত হয়। যেমনঃ কপোতাক্ষ, ব্রহ্মপুত্র, নীল নদ ইত্যাদি নদ। তবে এই নিয়ম সেসকল নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,যাদের নাম পৌরাণিক।


ভূপৃষ্ঠের নদী: ভূগর্ভস্থ এবং উপগ্লাসিয়াল অধিকাংশ কিন্তু সব নদীই ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হয় না। ভূগর্ভস্থ নদী গুহা বা গুহায় ভূগর্ভে প্রবাহিত হয়। চুনাপাথর ভূতাত্ত্বিক গঠন সহ অঞ্চলগুলিতে এই জাতীয় নদীগুলি প্রায়শই পাওয়া যায়। সাবগ্লাসিয়াল স্রোতগুলি হল বিনুনিযুক্ত নদী যা হিমবাহ এবং বরফের শীটগুলির বিছানায় প্রবাহিত হয়, যা হিমবাহের সামনের দিকে গলে যাওয়া জলকে নিঃসরণ করার অনুমতি দেয়। হিমবাহের অত্যধিক ওজনের কারণে চাপের গ্রেডিয়েন্টের কারণে, এই জাতীয় স্রোতগুলি এমনকি চড়াই পর্যন্ত প্রবাহিত হতে পারে।


নদীগুলির স্ট্রিম অর্ডার শ্রেণিবিভাগ: ফ্লুভ এবং রিভিয়ের স্ট্রাহলার স্ট্রীম অর্ডার অবদানকারী উপনদীগুলির সংযোগ এবং শ্রেণিবিন্যাসের উপর ভিত্তি করে নদীগুলিকে স্থান দেয়। হেডওয়াটারগুলি প্রথম ক্রম এবং আমাজন নদী দ্বাদশ ক্রম। বিশ্বের প্রায় 80% নদী এবং স্রোত প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্রমে।


কিছু কিছু ভাষায়, নদীগুলির মধ্যে পার্থক্য করা হয় তাদের স্রোতের ক্রম অনুসারে। ফরাসী ভাষায়, উদাহরণস্বরূপ, সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত নদীগুলিকে বলা হয় ফ্লিউভ, অন্য নদীগুলিকে রিভিয়ার বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কানাডায়, ম্যানিটোবার চার্চিল নদীকে লা রিভিয়ার চার্চিল বলা হয় কারণ এটি হাডসন উপসাগর পর্যন্ত চলে, কিন্তু ল্যাব্রাডরের চার্চিল নদীটিকে লে ফ্লিউভ চার্চিল বলা হয় কারণ এটি আটলান্টিক মহাসাগরে চলে যায়। যেহেতু ফ্রান্সের বেশিরভাগ নদী তাদের নামে পরিচিত হয় শুধুমাত্র rivière বা fleuve শব্দ দ্বারা। ফ্রাঙ্কোফোনির অন্যতম প্রধান নদী যা সাধারণত (সেন্ট লরেন্স নদী) নামে পরিচিত।


যেহেতু অনেক ফ্লেউভ বড় এবং বিশিষ্ট, অনেক উপনদী গ্রহণ করে, শব্দটি কখনও কখনও নির্দিষ্ট বড় নদীগুলিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যেগুলি অন্যান্য জলপ্রবাহে প্রবাহিত হয়; যাইহোক, এমনকি সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত ছোট স্রোতগুলিকে বলা হয় ফ্লুভ (যেমন ফ্লেউভ কোটিয়ার, "উপকূলীয় ফ্লেউভ")।


টপোগ্রাফিক শ্রেণিবিভাগ: বেডরক এবং পাললিক নদী

নদীগুলিকে সাধারণত পলি, বেডরক বা দুটির কিছু মিশ্রণ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে। পলিমাটি নদীগুলিতে চ্যানেল এবং প্লাবনভূমি রয়েছে যা অসংহত বা দুর্বলভাবে একত্রিত পলিতে স্ব-গঠিত। তারা তাদের তীর ক্ষয় করে এবং বার এবং তাদের প্লাবনভূমিতে উপাদান জমা করে।


বেডরক নদী বেডরক নদী তৈরি হয় যখন নদীটি আধুনিক পলির মধ্য দিয়ে এবং অন্তর্নিহিত বেডরকে নেমে আসে। এটি এমন অঞ্চলে ঘটে যেগুলি কিছু ধরনের উত্থান অনুভব করেছে (যার ফলে নদীর গ্রেডিয়েন্টগুলি খাড়া হয়ে যায়) বা যেখানে একটি বিশেষভাবে শক্ত লিথোলজির কারণে একটি নদী একটি খাড়া নাগালের কারণ হয় যা আধুনিক পলিমাটিতে আচ্ছাদিত হয়নি। বেডরক নদীগুলি প্রায়শই তাদের বিছানায় পলল থাকে; এই উপাদান চ্যানেল ক্ষয় এবং ভাস্কর্য গুরুত্বপূর্ণ. যে নদীগুলি বেডরক এবং গভীর পলিমাটির প্যাচগুলির মধ্য দিয়ে যায় সেগুলিকে মিশ্র বেডরক-পলল হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।


পলি নদী উপ-প্রকার: যৌবন, পরিপক্ক, বৃদ্ধ এবং পুনরুজ্জীবিত

পাললিক নদীগুলিকে তাদের চ্যানেলের প্যাটার্ন দ্বারা আরও শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে যেমন মেন্ডারিং, ব্রেইডেড, ওয়ান্ডারিং, অ্যানাস্টোমোস বা সোজা। পলল নদীর নাগালের রূপবিদ্যা পলল সরবরাহ, উপস্তর গঠন, স্রাব, গাছপালা এবং বিছানা বৃদ্ধির সংমিশ্রণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।


২০ শতকের শুরুতে উইলিয়াম মরিস ডেভিস তাদের "বয়স" এর উপর ভিত্তি করে নদীগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য "ক্ষয়ের চক্র" পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। যদিও ডেভিসের সিস্টেমটি আজও অনেক বইয়ে পাওয়া যায়, ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকের পরে এটি ক্রমবর্ধমানভাবে সমালোচিত এবং ভূতত্ত্ববিদদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে ওঠে। তার স্কিম পরীক্ষাযোগ্য অনুমান তৈরি করেনি এবং তাই অ-বৈজ্ঞানিক বলে মনে করা হয়েছিল। ডেভিসের নদী "বয়স" এর উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে:


যৌবন নদী: একটি খাড়া গ্রেডিয়েন্ট সহ একটি নদী যার খুব কম উপনদী রয়েছে এবং দ্রুত প্রবাহিত হয়। এর চ্যানেলগুলি প্রশস্ত হওয়ার পরিবর্তে আরও গভীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। উদাহরণ হল ব্রাজোস, ট্রিনিটি এবং ইব্রো নদী। প্রাপ্তবয়স্ক নদী: একটি গ্রেডিয়েন্ট সহ একটি নদী যা তরুণ নদীর তুলনায় কম খাড়া এবং আরও ধীরে প্রবাহিত হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক নদী অনেক উপনদী দ্বারা খাওয়ানো হয় এবং একটি যৌবনের নদীর চেয়ে বেশি স্রাব হয়। এর চ্যানেলগুলি গভীরতর না হয়ে প্রশস্ত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। উদাহরণ হল মিসিসিপি, সেন্ট লরেন্স, দানিউব, ওহিও, টেমস এবং পারানা নদী। পুরাতন নদী: নিম্ন গ্রেডিয়েন্ট এবং কম ক্ষয়কারী শক্তি সহ একটি নদী। পুরাতন নদীগুলি বন্যা সমভূমি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। উদাহরণ হল হলুদ, নিম্ন গঙ্গা, টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, সিন্ধু এবং নিম্ন নীল নদ। পুনরুজ্জীবিত নদী: একটি গ্রেডিয়েন্ট সহ একটি নদী যা টেকটোনিক উত্থান দ্বারা উত্থিত হয়। উদাহরণ হল রিও গ্র্যান্ডে এবং কলোরাডো নদী। ব্র্যাডশ মডেল দ্বারা সংক্ষিপ্তভাবে একটি নদীর বৈশিষ্ট্যগুলি তার উপরের এবং নীচের গতিপথের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। চ্যানেলের ঢাল, গভীরতা এবং প্রস্থের মধ্যে শক্তি-আইন সম্পর্ক "নদী শাসন" দ্বারা নিষ্কাশনের একটি ফাংশন হিসাবে দেওয়া হয়।


নদীর জৈব শ্রেণিবিভাগ: ক্রেনন, রিথ্রন, পোটামন

জৈবিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে যা সাধারণত সবচেয়ে অলিগোট্রফিক বা অদূষিত থেকে সবচেয়ে ইউট্রোফিক বা দূষিত পর্যন্ত শ্রেণী নির্ধারণ করে। অন্যান্য সিস্টেমগুলি একটি সম্পূর্ণ ইকো-সিস্টেম পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে যেমন পরিবেশের জন্য নিউজিল্যান্ড মন্ত্রক দ্বারা উন্নত। ইউরোপে, ওয়াটার ফ্রেমওয়ার্ক ডাইরেক্টিভের প্রয়োজনীয়তা মৎস্য অবস্থার উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগ সহ বিস্তৃত শ্রেণিবিন্যাসের পদ্ধতির বিকাশের দিকে পরিচালিত করেছে


ফ্রাঙ্কোফোন সম্প্রদায়ে ব্যবহৃত নদী জোনেশনের একটি সিস্টেম নদীগুলিকে তিনটি প্রাথমিক অঞ্চলে বিভক্ত করে:


ক্রেনন হল নদীর উৎসের সবচেয়ে উপরের অঞ্চল। এটি আবার ইউক্রেনন (বসন্ত বা ফোড়া জোন) এবং হাইপোক্রেনন (ব্রুক বা হেডস্ট্রিম জোন) এ বিভক্ত। এই এলাকায় কম তাপমাত্রা, অক্সিজেনের পরিমাণ কম এবং ধীর গতিতে চলমান জল রয়েছে। রাইথ্রন হল নদীর উজানের অংশ যা ক্রেননকে অনুসরণ করে। এটির তুলনামূলকভাবে শীতল তাপমাত্রা, উচ্চ অক্সিজেনের মাত্রা এবং দ্রুত, অশান্ত, দ্রুত প্রবাহ রয়েছে। পটামন হল নদীর অবশিষ্ট ভাটা প্রসারিত। এর উষ্ণ তাপমাত্রা, কম অক্সিজেনের মাত্রা, ধীর প্রবাহ এবং স্যান্ডিয়ার বটম রয়েছে।


নেভিগেশন অসুবিধা শ্রেণিবিভাগ

নদীর অসুবিধার আন্তর্জাতিক স্কেল ন্যাভিগেশন-বিশেষ করে র‍্যাপিডের চ্যালেঞ্জগুলিকে রেট দিতে ব্যবহৃত হয়। ক্লাস I সবচেয়ে সহজ এবং ক্লাস VI সবচেয়ে কঠিন


নদীর ভৌগোলিক জ্ঞান ও গাণিতিক সূত্র

নদীর উৎসমূল সাধারণত একটি সু-উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল, যেখানে বরফগলা পানি ও বৃষ্টির পানি একটি ঢাল বেয়ে মাধ্যাকর্ষণজনিত প্রবল স্রোতস্বিনী সৃষ্টি করে। একাধিক ক্ষুদ্র জলধারার পর্যায়ক্রমিক সমন্বিত প্রক্রিয়াই পর্বতের গা ক্ষয় করে নদীনালার সৃষ্টি করে।

পর্যায়গুলো হচ্ছে (হোমস, ১৯৫১)

পাতপ্রবাহ-মিহিনালি-শিরানালি-গুহানালি-নদী উপত্যকা। কার্যত নদী উৎসমূলে ক্ষয়কার্য কয়েকটি নিয়ামক দ্বারা প্রবাহিত, যেমন-


E = F (S+,Q+,V+,R-); যখন-

E = ক্ষয়ক্রিয়ার মাত্রা

F = কার্যচিহ্ন

S = ভূমির ঢাল

Q = প্রবহমান

V = প্রবাহগতি

R = বন্ধুরতা ও শিলাকাঠিন্য


সহজেই অনুমেয় যে একটি নদীর ধারা সৃষ্টির পেছনে ঐসব অনুকূল ও প্রতিকূল নিয়ামকের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব অপরিহার্য। আবার নদীর প্রবাহগতি ও ক্ষয়ক্রিয়া পরস্পর আনুপাতিক কিন্তু প্রবাহগতিমাত্রা, অববাহিকার ঢাল ভূমিরূপের উপর নির্ভরশীল, যা ভূবিজ্ঞানী চেজি’র সমীকরণ অনুযায়ী নিম্নরূপ-

V = CVRS; যখন-

V = প্রবাহগতি

S = ভূমির ঢাল

R = ভূমি বন্ধুরতা ও শিলাকাঠিন্য

C = ধ্রুব সংখ্যা


যে কোন নদীর গঠনরূপ, পর্যায়, প্রকৃতি ও ক্রিয়াকান্ড নিয়তই বিবর্তনশীল। এ রূপান্তর পর্যায়গুলো ‘অর্গানিসমিক কনসেপ্ট’ অনুসারে একটি জীবন্ত প্রাণীর সাথে তুলনীয়। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত নদীর তিনটি প্রধান পর্যায়-


তরুণ → পরিণত → বৃদ্ধ

ক্ষয়ভবন → পরিবহন → সঞ্চায়ন


বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলোর উৎস হিমালয় পর্বত। বরফগলা পানি ও বৃষ্টির পানি প্রবলবেগে উত্তর থেকে দক্ষিণে সর্পিল গতিতে বইতে থাকে। এদের গন্তব্যস্থল বঙ্গোপসাগর।[১]


নদীর স্রোত

নদীর প্রবাহ অধ্যয়ন, জলবিদ্যার একটি দিক।


প্রবাহ বৈশিষ্ট্য


প্রবাহ দিক মাধ্যাকর্ষণ থেকে প্রাপ্ত শক্তি নিয়ে নদীগুলি উতরাই প্রবাহিত হয়। দিকটি কম্পাসের সমস্ত দিককে জড়িত করতে পারে এবং এটি একটি জটিল পথ হতে পারে।


উতরাই প্রবাহিত নদী, নদীর উৎস থেকে নদীর মুখ পর্যন্ত, অগত্যা সংক্ষিপ্ততম পথ গ্রহণ করে না। পাললিক স্রোতের জন্য, সোজা এবং বিনুনিযুক্ত নদীগুলির সাইনোসিটি খুব কম থাকে এবং এটি সরাসরি পাহাড়ের নিচে প্রবাহিত হয়, যখন প্রবাহিত নদীগুলি উপত্যকা জুড়ে এদিক-ওদিক প্রবাহিত হয়। বেডরক নদীগুলি সাধারণত একটি ফ্র্যাক্টাল প্যাটার্নে প্রবাহিত হয় বা একটি প্যাটার্ন যা বেডরকের দুর্বলতা দ্বারা নির্ধারিত হয়, যেমন ফল্ট, ফ্র্যাকচার বা আরও ক্ষয়যোগ্য স্তর।


প্রবাহ হার আয়তনের প্রবাহের হার, যা স্রাব, আয়তনের প্রবাহ হার এবং জল প্রবাহের হার নামেও পরিচিত, হল জলের আয়তন যা প্রতি একক সময়ে নদীর চ্যানেলের একটি প্রদত্ত ক্রস-সেকশনের মধ্য দিয়ে যায়। এটি সাধারণত কিউবিক মিটার প্রতি সেকেন্ডে (কিউমেক) বা কিউবিক ফুট প্রতি সেকেন্ডে (সিএফএস) পরিমাপ করা হয়, যেখানে 1 m3/s = 35.51 ft3/s; এটি কখনও কখনও প্রতি সেকেন্ডে লিটার বা গ্যালনে পরিমাপ করা হয়।


ভলিউমেট্রিক প্রবাহ হারকে প্রদত্ত ক্রস-সেকশনের মধ্য দিয়ে প্রবাহের গড় বেগ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে, ক্রস-বিভাগীয় এলাকার গুণ। প্রাচীর আইন ব্যবহারের মাধ্যমে গড় বেগ আনুমানিক করা যেতে পারে। সাধারণভাবে, নদী চ্যানেলের গভীরতা (বা হাইড্রোলিক ব্যাসার্ধ) এবং ঢালের সাথে বেগ বৃদ্ধি পায়, যখন ক্রস-বিভাগীয় এলাকা গভীরতা এবং প্রস্থের সাথে স্কেল করে: গভীরতার দ্বিগুণ গণনা স্রাব নির্ধারণে এই পরিবর্তনশীলটির গুরুত্ব দেখায়। চ্যানেলের মাধ্যমে।


প্রবাহের প্রভাব

ফ্লুভিয়াল ক্ষয় যৌবনকালে নদীটি জলপ্রবাহে ক্ষয় সৃষ্টি করে, উপত্যকাকে গভীর করে। হাইড্রোলিক ক্রিয়া শিলাকে আলগা করে এবং অপসারণ করে যা তীর এবং নদীর তলকে আরও ক্ষয় করে। সময়ের সাথে সাথে, এটি নদীর তলকে গভীর করে এবং খাড়া পাশ তৈরি করে যা পরে আবহাওয়ায় পরিণত হয়।


তীরগুলির খাড়া প্রকৃতির কারণে উপত্যকার দিকগুলি নীচের দিকে সরে যায় যার ফলে উপত্যকাটি V- আকৃতির হয়ে যায়।


যৌবনের নদী উপত্যকায়ও জলপ্রপাত তৈরি হয় যেখানে শক্ত পাথরের একটি ব্যান্ড নরম পাথরের একটি স্তরকে আবৃত করে। ডিফারেনশিয়াল ক্ষয় ঘটে কারণ নদী শক্ত শিলার চেয়ে নরম শিলাকে আরও সহজে ক্ষয় করে, এটি শক্ত শিলাকে আরও উঁচুতে ফেলে এবং নীচের নদী থেকে আলাদা হয়ে যায়। একটি নিমজ্জন পুল নীচের অংশে গঠন করে এবং জলবাহী ক্রিয়া এবং ঘর্ষণ এর ফলে গভীর হয়।


বন্যা বন্যা একটি নদীর চক্রের একটি প্রাকৃতিক অংশ। নদী নালাগুলির সিংহভাগ ক্ষয় এবং সংশ্লিষ্ট প্লাবনভূমিতে ক্ষয় ও অবক্ষয় বন্যার পর্যায়ে ঘটে। অনেক উন্নত অঞ্চলে, মানুষের কার্যকলাপ নদী নালার রূপ পরিবর্তন করেছে, পরিবর্তিত হয়েছে মাত্রা এবং বন্যার ফ্রিকোয়েন্সি। এর কিছু উদাহরণ হল লেভ নির্মাণ, চ্যানেল সোজা করা এবং প্রাকৃতিক জলাভূমির নিষ্কাশন। অনেক ক্ষেত্রে নদী ও প্লাবনভূমিতে মানুষের কর্মকাণ্ড নাটকীয়ভাবে বন্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। নদীগুলিকে সোজা করার ফলে জল নীচের দিকে আরও দ্রুত প্রবাহিত হতে দেয়, যা আরও নীচের দিকে বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়। বন্যা সমভূমিতে নির্মাণ বন্যা সঞ্চয়স্থান অপসারণ করে, যা আবার নিম্নধারার বন্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। লেভের বিল্ডিং শুধুমাত্র লেভের পিছনের এলাকাকে রক্ষা করে এবং আরও নিচের দিকে নয়। সরু চ্যানেলের তীর দ্বারা নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ব্যাক-ওয়াটার চাপের কারণে লেভ এবং বন্যা-তীরগুলিও উজান থেকে বন্যা বাড়াতে পারে। আটক অববাহিকাগুলি অবশেষে বন্যার জলের কিছু অংশ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে বন্যার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে।


আউটলেট এর পলি ফলন পলল ফলন হল একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে একটি নিষ্কাশন বেসিনের আউটলেটে পৌঁছানো কণা পদার্থের মোট পরিমাণ (সাসপেন্ড বা বেডলোড)। ফলন সাধারণত প্রতি বর্গ কিলোমিটার প্রতি বছর কিলোগ্রাম হিসাবে প্রকাশ করা হয়। পলল বিতরণ প্রক্রিয়াগুলি নিষ্কাশন এলাকার আকার, বেসিনের ঢাল, জলবায়ু, পলির ধরন (লিথোলজি), গাছপালা আবরণ এবং মানুষের ভূমি ব্যবহার/ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের মতো অসংখ্য কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। 'পলল বিতরণ অনুপাত' (ফলন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত মোট পলির পরিমাণের মধ্যে অনুপাত) এর তাত্ত্বিক ধারণাটি নির্দেশ করে যে সমস্ত পলল একটি নির্দিষ্ট ক্যাচমেন্টের মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না যা আউটলেট পর্যন্ত পৌঁছায় (উদাহরণস্বরূপ, প্লাবনভূমিতে জমা হওয়ার কারণে)) এই ধরনের স্টোরেজ সুযোগগুলি সাধারণত বড় আকারের ক্যাচমেন্টে বৃদ্ধি পায়, এইভাবে ফলন এবং পলল বিতরণ অনুপাত কম হয়।


লোনা পানি বেশিরভাগ নদী যেখানে সমুদ্রের সাথে মিলিত হয় সেখানে লোনা জল দেখা দেয়। লোনা পানির ব্যাপ্তি উজানে উল্লেখযোগ্য দূরত্ব প্রসারিত করতে পারে, বিশেষ করে উচ্চ জোয়ারের রেঞ্জ সহ এলাকায়।


নদীর বাস্তুতন্ত্র

নদীর বায়োটা রিপারিয়ান অঞ্চলের জীবগুলি নদীর চ্যানেলের অবস্থান এবং প্রবাহের ধরণগুলির পরিবর্তনে সাড়া দেয়। নদীর বাস্তুতন্ত্র সাধারণত নদী ধারাবাহিক ধারণা দ্বারা বর্ণনা করা হয়, এতে বাঁধ এবং জলপ্রপাত এবং অস্থায়ী ব্যাপক বন্যার অনুমতি দেওয়ার জন্য কিছু সংযোজন এবং পরিমার্জন রয়েছে। ধারণাটি নদীকে একটি সিস্টেম হিসাবে বর্ণনা করে যেখানে ভৌত পরামিতি, খাদ্য কণার প্রাপ্যতা এবং বাস্তুতন্ত্রের গঠন তার দৈর্ঘ্য বরাবর ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। উজানের অংশ থেকে যে খাদ্য (শক্তি) অবশিষ্ট থাকে তা ডাউনস্ট্রিম ব্যবহার করা হয়।


সাধারণ প্যাটার্ন হল যে প্রথম ক্রম প্রবাহে কণা পদার্থ (পার্শ্ববর্তী বন থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত পাতা) থাকে যা সেখানে Plecoptera লার্ভার মত শ্রেডার দ্বারা প্রক্রিয়া করা হয়। এই শ্রেডারগুলির পণ্যগুলি সংগ্রাহকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়, যেমন হাইড্রোসাইকিডি এবং আরও নীচের দিকের শেত্তলাগুলি যা প্রাথমিক উত্পাদন তৈরি করে যা জীবের প্রধান খাদ্য উত্স হয়ে ওঠে। সমস্ত পরিবর্তনগুলি ধীরে ধীরে হয় এবং প্রতিটি প্রজাতির বন্টনকে একটি স্বাভাবিক বক্ররেখা হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে, যেখানে শর্তগুলি সর্বোত্তম সর্বোচ্চ ঘনত্বের সাথে। নদীতে উত্তরাধিকার কার্যত অনুপস্থিত এবং বাস্তুতন্ত্রের গঠন স্থির থাকে।


নদীর রসায়ন নদীর রসায়ন জটিল এবং বায়ুমণ্ডল থেকে আসা ইনপুট, ভূতত্ত্ব যার মাধ্যমে এটি ভ্রমণ করে এবং মানুষের কার্যকলাপের ইনপুটগুলির উপর নির্ভর করে। জলের রাসায়নিক সংমিশ্রণ গাছপালা এবং প্রাণী উভয়ের জন্য সেই জলের বাস্তুশাস্ত্রের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলে এবং এটি নদীর জলের তৈরি হতে পারে এমন ব্যবহারগুলিকেও প্রভাবিত করে। নদীর জলের রসায়ন বোঝার এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত করার জন্য একটি ভাল ডিজাইন করা এবং পরিচালিত নমুনা এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন।


নদীর ব্যবহার

নির্মাণ সামগ্রী মোটা পলি, নুড়ি এবং বালি, নদী দ্বারা উৎপন্ন এবং সরানো নির্মাণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের কিছু অংশে এটি ব্যাপক নতুন হ্রদের আবাসস্থল তৈরি করতে পারে কারণ নুড়ির গর্তগুলি আবার জলে ভরে যায়। অন্যান্য পরিস্থিতিতে এটি নদীর তলদেশ এবং নদীর গতিপথকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং ডিম পাড়ার জন্য স্থিতিশীল নুড়ি গঠনের উপর নির্ভরশীল মাছের জনসংখ্যার জন্য মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। উচ্চভূমির নদীগুলিতে, সাদা জলের সাথে র্যাপিড বা এমনকি জলপ্রপাত ঘটে। র‍্যাপিড প্রায়ই বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হয়, যেমন হোয়াইটওয়াটার কায়াকিং।


শক্তি উৎপাদন


বেলজিয়ামের ওয়াটারমিল। দ্রুত প্রবাহিত নদী এবং জলপ্রপাতগুলি জলকল এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে শক্তির উত্স হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ওয়াটারমিলের প্রমাণ দেখায় যে সেগুলি বহু শত বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে, উদাহরণস্বরূপ ডনবি ক্লিক মিলের অর্কনিতে। বাষ্প শক্তি উদ্ভাবনের আগে, সিরিয়াল পিষানোর জন্য এবং উল এবং অন্যান্য বস্ত্র প্রক্রিয়াকরণের জন্য ওয়াটারমিলগুলি ইউরোপ জুড়ে সাধারণ ছিল। ১৮৯০-এর দশকে নর্থম্বারল্যান্ডের ক্র্যাগসাইডের মতো জায়গায় নদীর জল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রথম মেশিনগুলি স্থাপিত হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বিশেষ করে নরওয়ের মতো আর্দ্র পার্বত্য অঞ্চলে জল থেকে বৃহৎ আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। .


খাদ্যের উৎস প্রাক-ইতিহাস থেকেই নদীগুলো খাদ্যের উৎস। এগুলি প্রায়শই মাছ এবং অন্যান্য ভোজ্য জলজ জীবনের একটি সমৃদ্ধ উত্স এবং এটি মিষ্টি জলের একটি প্রধান উত্স, যা পানীয় এবং সেচের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। নদীগুলি শহর এবং আশেপাশের শহরগুলির শহুরে রূপ নির্ধারণ করতে সহায়তা করে এবং তাদের করিডোরগুলি প্রায়শই নদীর হাঁটার মতো অগ্রভাগের রাস্তাগুলির বিকাশের মাধ্যমে শহুরে পুনর্নবীকরণের সুযোগ দেয়। নদীগুলি বর্জ্য জল এবং, স্বল্প উন্নত বিশ্বের অন্যান্য বর্জ্য নিষ্পত্তির একটি সহজ উপায়ও সরবরাহ করে।


নেভিগেশন এবং পরিবহন নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে নৌচলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নৌচলাচলের প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতায়, যা উত্তর-পশ্চিম ভারতে ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিদ্যমান ছিল। নদীপথে নৌচলাচল পরিবহনের একটি সস্তা মাধ্যম সরবরাহ করে এবং এখনও বিশ্বের বেশিরভাগ প্রধান নদী যেমন আমাজন, গঙ্গা, নীল, মিসিসিপি এবং সিন্ধুতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু নদীর নৌকাগুলি প্রায়শই নিয়ন্ত্রিত হয় না, তারা পরিবহন দ্বারা নির্গত কণা নিঃশ্বাসের কারণে বিশ্বব্যাপী গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনে এবং স্থানীয় ক্যান্সারে একটি বড় পরিমাণ অবদান রাখে।


স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং কানাডার মতো কিছু ভারী বনাঞ্চলে, কাঠবাদামরা আরও প্রক্রিয়াকরণের জন্য ভাসমান গাছগুলিকে ভাসিয়ে কাঠের শিবিরে ভাসানোর জন্য নদী ব্যবহার করে, প্রাকৃতিক উপায়ে বিশাল ভারী কাঠগুলি পরিবহন করে অনেক প্রচেষ্টা এবং খরচ বাঁচায়।


রাজনৈতিক সীমানা রাজনৈতিক সীমানা নির্ধারণ এবং দেশ রক্ষায় নদীগুলি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, দানিউব ছিল রোমান সাম্রাজ্যের একটি দীর্ঘস্থায়ী সীমানা, এবং আজ এটি বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়ার মধ্যে বেশিরভাগ সীমানা তৈরি করে। উত্তর আমেরিকার মিসিসিপি এবং ইউরোপের রাইন এই মহাদেশগুলির প্রধান পূর্ব-পশ্চিম সীমানা। দক্ষিণ আফ্রিকার অরেঞ্জ এবং লিম্পোপো নদীগুলি তাদের রুট বরাবর প্রদেশ এবং দেশগুলির মধ্যে সীমানা তৈরি করে।


পবিত্র নদী পবিত্র নদী এবং তাদের শ্রদ্ধা বিভিন্ন ধর্মে পাওয়া একটি ঘটনা, বিশেষ করে যে ধর্মগুলি তাদের ধর্মের মূল হিসাবে পরিবেশ বান্ধব বিশ্বাস রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ধর্ম (বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম, এবং সিকধর্ম) উপাসনা, গাছ, পর্বত এবং নদীকে পবিত্র হিসাবে শ্রদ্ধা করে এবং সংরক্ষণ করে। হিন্দুধর্মের সবচেয়ে পবিত্র নদীগুলির মধ্যে রয়েছে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী নদী যার উপর ঋগ্বেদিক নদীগুলি বিকাশ লাভ করেছিল। বেদ এবং গীতা, হিন্দু গ্রন্থগুলির মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থগুলি সরস্বতী নদীর তীরে রচিত হয়েছিল যেগুলি বর্তমান হরিয়ানায় কুরু রাজ্যের সময় কোড করা হয়েছিল। হিন্দুধর্মের অন্যান্য গৌণ পবিত্র নদীগুলির মধ্যে নর্মদা এবং আরও অনেকগুলি


নদী ব্যবস্থাপনা

নদীগুলিকে প্রায়শই পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত করা হয় যাতে সেগুলিকে আরও বেশি উপযোগী বা মানুষের ক্রিয়াকলাপে কম ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে, জল সঞ্চয় করতে বা শক্তি আহরণের জন্য বাঁধ বা ওয়্যার তৈরি করা যেতে পারে। ইউরোপে ডাইক নামে পরিচিত লেভগুলি নদীর জলকে প্লাবনভূমি বা প্লাবনপথে প্রবাহিত হতে বাধা দেওয়ার জন্য নির্মিত হতে পারে। জল স্থানান্তর বা নৌচলাচলের জন্য খালগুলি নদীগুলিকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে।ন্যাভিগেশন উন্নত করতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা যেতে পারে, বা প্রবাহের হার বাড়াতে সোজা করা যেতে পারে। নদী ব্যবস্থাপনা একটি ক্রমাগত ক্রিয়াকলাপ কারণ নদীগুলি মানুষের দ্বারা করা পরিবর্তনগুলিকে 'পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার' প্রবণতা রাখে। ড্রেজ করা চ্যানেলগুলি পলি হয়ে যায়, স্লুইস মেকানিজমগুলি বয়সের সাথে খারাপ হয়ে যায়, লেভিস এবং ড্যামগুলি সিপাজ বা বিপর্যয়কর ব্যর্থতার শিকার হতে পারে। নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যে সুবিধাগুলি চাওয়া হয় তা প্রায়শই এই ধরনের ব্যবস্থাপনার খারাপ প্রভাবগুলি প্রশমিত করার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক খরচ দ্বারা অফসেট করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, উন্নত বিশ্বের কিছু অংশে, নদীগুলিকে উন্নয়নের জন্য সমতল বন্যা-সমভূমি মুক্ত করার জন্য চ্যানেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। বন্যা উচ্চ আর্থিক খরচে এবং প্রায়শই প্রাণহানির সাথে এই ধরনের উন্নয়নকে প্লাবিত করতে পারে।


নদীগুলি আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে পরিচালিত হচ্ছে, কারণ এগুলি অনেক জলজ ও নদীতীরীয় উদ্ভিদ, বাসিন্দা এবং পরিযায়ী মাছ, জলপাখি, শিকারী পাখি, পরিযায়ী পাখি এবং অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।


উদ্বেগ

মানবসৃষ্ট কারণগুলি, যেমন অতিরিক্ত শোষণ এবং দূষণ, সবচেয়ে বড় হুমকি এবং উদ্বেগ যা নদীগুলিকে পরিবেশগতভাবে মৃত এবং নদীগুলিকে শুকিয়ে দিচ্ছে।


প্লাস্টিক দূষণ প্রাকৃতিক পরিবেশে প্লাস্টিকের স্থায়িত্বের কারণে জলজ জীবন এবং নদীর বাস্তুতন্ত্রের উপর হুমকির সৃষ্টি করে।  প্লাস্টিক ধ্বংসাবশেষের ফলে কচ্ছপ, পাখি এবং মাছের মতো জলজ প্রাণীর দ্বারা জড়ান এবং গ্রহণ করা হতে পারে, যা গুরুতর আঘাত ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।  নদ-নদীর আশেপাশে মানুষের জীবিকাও প্লাস্টিক দূষণ দ্বারা প্রভাবিত হয় শিপিং এবং পরিবহন জাহাজের সরাসরি ক্ষতি, পর্যটন বা রিয়েল এস্টেট মূল্যের উপর প্রভাব, এবং ড্রেন এবং অন্যান্য জলবাহী অবকাঠামো আটকে যাওয়ার ফলে বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের নদ-নদী

বলা হয়ে থাকে হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে ঠিক কত নদী আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে নেই। কোন নদী কোথা থেকে উৎপত্তি হয়ে কোথায় শেষ হয়েছে কিংবা একটি নদী আরেকটি নদীকে কোথায় অতিক্রম করেছে এসব যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ এখনো মানুষের অজানা। অনেক গবেষকদের মতে বাংলাদেশে উপনদী ও শাখানদীর মোট সংখ্যা ২২৫। তবে নদী, উপনদী ও শাখানদীর সর্বমোট সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতদ্বৈততা আছে। একটি নদী থেকে অসংখ্য নদী সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোন কোন নদী থেকে খাল বা ছড়া উৎপন্ন হয়েছে। এগুলোও প্রাকৃতিক নদীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন- কর্ণফুলী নদী। মোহনা থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত এই নদীতে অন্তত ২৪-২৫টি ছোটবড় উপনদী এসে মিশেছে। এই হিসাব থেকে অনুমান করলে বাংলাদেশকে হাজার নদীর দেশ বলা যেতে পারে। যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীতে রয়েছে অজস্র নদী। এসব নদীর নামকরণও ঠিকমত হয়নি। আবার কোন কোন নদীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন নাম। বাংলাদেশের প্রধান নদী পাঁচটি- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, পশুর ও কর্ণফুলী। এরপর আসে তিস্তা, গড়াই, মধুমতী, রুপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, কীর্তনখোলা, বিষখালী ইত্যাদি নদ-নদীর নাম। এসব নদীর মধ্যে কোনটা বড় কোনটা ছোট বলা কঠিন। তবে অনুমান ও হিসাব কষে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৭০০ নদী আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।


জীবন ও জীবিকায় নদীর ভূমিকা

প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ নদ নদীর তীরবর্তী সমতলভূমিতে বসবাস শুরু করে। নদীকে ঘিরেই বিশ্বের প্রতিটি শহর, বন্দর, বাজার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। এভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা, কর্ণফুলীর তীরে চট্টগ্রাম, শীতলক্ষ্যার তীরে নারায়ণগঞ্জ, সুরমার তীরে সিলেট, গোমতীর তীরে কুমিল্লা ইত্যাদি লক্ষ করা যায়। নদ-নদীই মানুষের খাদ্য ও রোজগার এর প্রধান উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করে। মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের সহজ উপায় হলো নৌকা। মালামাল পরিবহনে খুবই স্বল্প খরচে নৌকার জুড়ি মেলা ভার। যিনি নৌকা চালান তিনি মাঝি হিসেবে পরিচিত। একসময় নৌকায় পাল তোলা থাকত। সময়ের বিবর্তনে এর স্থান দখল করেছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা, স্টিমার। মাঝ নদীতে জেলেরা উত্তাল তরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে মাছ আহরণ করে। নদী পাড়াপাড়ে ইজারাদার কর্তৃক কর হিসেবে অর্থ আদায় করতে দেখা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতার সূত্রপাত হয় নদীকে কেন্দ্র করে।


যানবাহন

নৌকা ও নদী - একে-অপরের পরিপূরক। নদীতে মূলত নৌকা চললেও লঞ্চ, স্টিমার, স্পীডবোট, ট্রলার ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায়।


সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতে নদী

বাংলা সাহিত্যে নদী গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তন্মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পদ্মা নদীর মাঝি অন্যতম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সুজন-সখী’র গান হিসেবে ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলা নেব সখী’ - প্রেমের গানটি তৎকালীন সময়ে সকলের মুখে মুখে ছিল। সঙ্গীত জগতে ‘নদী’ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। মান্নাদে’র এ নদী এমন নদী; জগজিৎ সিং এর ‘নদীতে তুফান এলে কুল ভেঙ্গে যায়, সহজেই তাকে দেখা যায়। মনেতে তুফান এলে বুক ভেঙ্গে যায় দেখানোর নেইজে উপায়!’পথিক নবীর আমার একটা নদী ছিল। কিংবা আরতী মুখোপাধ্যায়ের ‘নদীর যেমন ঝরনা আছে, ঝরনারও নদী আছে’ ইত্যাদি অমর সঙ্গীত হিসেবে টিকে থাকবে আজীবন। এছাড়াও, মোহনায় এসে নদী পিছনের পথটাকি ভুলতে পারে - গানটি বেশ জনপ্রিয়। এই যে নদী যায় সাগরে, কত কথা সুধাই তারে, ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, বল কোথায় তোমার দেশ,তমার নেইকো চলার শেষ, নদী যদি বলে সাগরের কাছে আসব না


তা কী হয় ইত্যাদি।

পর্বত

 পর্বত হল পৃথিবীর ভূত্বকের একটি উঁচু অংশ, সাধারণত এর খাড়া দিকগুলিতে উন্মুক্ত নিরেট প্রস্তর দেখায়। যদিও এর বর্ণনা পরিবর্তিত হয়, একটি পর্বত একটি মালভূমি থেকে এদের চূড়ার উচ্চতার জন্য পার্থক্য করা যেতে পারে এবং সাধারণত একটি পাহাড়ের চেয়ে উঁচু হয়, সাধারণত আশেপাশের জমি থেকে কমপক্ষে ৩০০ মিটার (১,০০০ ফুট) উপরে উঠে। কয়েকটি পর্বত বিচ্ছিন্ন চূড়া, তবে বেশিরভাগ পর্বতশ্রেণীতে দেখা যায়।[১]


পর্বতগুলি টেকটোনিক শক্তি, ক্ষয় বা আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে গঠিত হয়,[১] যেখানে কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত সময়ের স্কেলে কাজ করে।[২] একবার পর্বত নির্মাণ বন্ধ হয়ে গেলে, স্লাম্পিং এবং অন্যান্য ধরনের ব্যাপক অপচয়ের, সেইসাথে নদী এবং হিমবাহের ক্ষয়ের দ্বারা, আবহাওয়ার ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পর্বত ধীরে ধীরে সমতল হয়।[৩] একই অক্ষাংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় ঠান্ডা জলবায়ু তৈরি করে পাহাড়ের উচ্চ উচ্চতা। এই ঠান্ডা জলবায়ু পাহাড়ের বাস্তুন্ত্রের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন গাছপালা এবং প্রাণী রয়েছে। কম অতিথিপরায়ণ ভূখণ্ড এবং জলবায়ুর কারণে, পর্বতমালা কৃষি কাজের জন্য কম এবং সম্পদ আহরণের জন্য বেশি ব্যবহার করা হয়, যেমন খনিজ আহরণ এবং বড় গাছের লগ কাটা, চিত্তবিনোদনের, যেমন পর্বত আরোহণ এবং বরফের উপর পিছলানো খেলার জন্য।


পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত হল এশিয়ার এভারেস্ট পর্বত হিমালয় পর্বতমালা , যার চূড়ার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,৮৫০ মি (২৯,০৩৫ ফু) উপরে। সৌরজগতের যেকোনো গ্রহের সর্বোচ্চ পরিচিত পর্বত হল মঙ্গল গ্রহে অলিম্পাস মনস যার চূড়ার উচ্চতা ২১,১৭১ মি (৬৯,৪৫৯ ফু) ।



তানজানিয়ার মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো, আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত

সংজ্ঞা


মাউন্ট এলব্রাস, ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত


ইন্দোনেশিয়ার পুনকাক জায়া, ওশেনিয়ার সর্বোচ্চ পর্বত

পাহাড়ের কোন সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। উচ্চতা, আয়তন, ত্রাণ, খাড়াতা, ব্যবধান এবং ধারাবাহিকতা একটি পর্বতকে সংজ্ঞায়িত করার মানদণ্ড হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে একটি পর্বতকে "পৃথিবী পৃষ্ঠের একটি প্রাকৃতিক উচ্চতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা আশেপাশের স্তর থেকে কমবেশি আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং একটি উচ্চতা অর্জন করে যা তুলনামূলকভাবে সন্নিহিত উচ্চতার সাথে চিত্তাকর্ষক বা উল্লেখযোগ্য।"


ভূমিরূপকে পর্বত বলা হবে কিনা তা স্থানীয় ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। জন হুইটোর ডিকশনারী অফ ফিজিক্যাল জিওগ্রাফি[৪] বলে "কিছু কর্তৃপক্ষ ৬০০ মিটার (১,৯৬৯ ফু) উপরে উচ্চতা বিশিষ্টদের পর্বত হিসাবে বিবেচনা করে , এ উচ্চতার নীচে যেগুলিকে পাহাড় হিসাবে উল্লেখ করা হয়।"


যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রে, একটি পর্বতকে সাধারণত কমপক্ষে ২,০০০ ফুট (৬১০ মি) উচ্চতা চূড়া হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়,[৫] যুক্তরাজ্য সরকারের সরকারী সংজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে একটি পর্বত, প্রবেশের উদ্দেশ্যে, ২,০০০ ফুট (৬১০ মি) একটি চূড়া বা উচ্চতর।[৬] এছাড়াও, কিছু সংজ্ঞায় একটি ভূ-সংস্থান প্রাধান্যের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে, যেমন পর্বতটি ৩০০ মিটার (৯৮৪ ফু) উপরে উঠে পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ডের উপরে।[১] এক সময় ইউএস বোর্ড অন জিওগ্রাফিক নেমস একটি পর্বতকে ১,০০০ ফুট (৩০৫ মি) লম্বা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল ,[৭] কিন্তু ১৯৭০ সাল থেকে এ সংজ্ঞা পরিত্যাগ করেছে। এই উচ্চতার চেয়ে কম যেকোন অনুরূপ ভূমিরূপ একটি পাহাড় হিসাবে বিবেচিত হত। যাইহোক, আজ, মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ উপসংহারে পৌঁছেছে যে এই পদগুলির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তিগত সংজ্ঞা নেই।[৮]


ইউএন এনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রামের "পার্বত্য পরিবেশ" এর সংজ্ঞা নিম্নলিখিত যে কোনো একটি অন্তর্ভুক্ত করে: :৭৪


শ্রেণি ১: ৪,৫০০ মি (১৪,৭৬৪ ফু) এর বেশি উচ্চতা ।

শ্রেণি ২: ৩,৫০০ মি (১১,৪৮৩ ফু) এর মধ্যে উচ্চতা এবং ৪,৫০০ মি (১৪,৭৬৪ ফু) ।

শ্রেণি ৩: ২,৫০০ মি (৮,২০২ ফু) এর মধ্যে উচ্চতা এবং ৩,৫০০ মি (১১,৪৮৩ ফু) ।

শ্রেণি ৪: ১,৫০০ মি (৪,৯২১ ফু) এর মধ্যে উচ্চতা এবং ২,৫০০ মি (৮,২০২ ফু), ২ ডিগ্রির বেশি ঢাল সহ।

শ্রেণি ৫: ১,০০০ মি (৩,২৮১ ফু) এর মধ্যে উচ্চতা এবং ১,৫০০ মি (৪,৯২১ ফু), ৫ ডিগ্রী এবং/অথবা ৩০০ মি (৯৮৪ ফু) এর বেশি ঢাল সহ উচ্চতা সীমা ৭ কিমি (৪.৩ মা) এর মধ্যে ।

শ্রেণি ৬: ৩০০ মি (৯৮৪ ফু) এর মধ্যে উচ্চতা এবং ১,০০০ মি (৩,২৮১ ফু), একটি ৩০০ মি (৯৮৪ ফু) সহ উচ্চতা সীমা ৭ কিমি (৪.৩ মা) এর মধ্যে ।

শ্রেণি ৭: বিচ্ছিন্ন অভ্যন্তরীণ অববাহিকা এবং মালভূমি ২৫ কিমি২ (৯.৭ মা২) এর কম এমন এলাকায় যা সম্পূর্ণভাবে শ্রেণি ১ থেকে ৬ পর্বত দ্বারা বেষ্টিত, কিন্তু নিজেরাই শ্রেণি ১ থেকে ৬ পর্বতমালার মানদণ্ড পূরণ করে না।

এই সংজ্ঞাগুলি ব্যবহার করে, পর্বতগুলি ইউরেশিয়ার ৩৩%, দক্ষিণ আমেরিকার ১৯%, উত্তর আমেরিকার ২৪% এবং আফ্রিকার ১৪% জুড়ে রয়েছে। :১৪সামগ্রিকভাবে, পৃথিবীর ভূমি ভরের ২৪% পাহাড়ী।[৯]

মহাসাগর

 মহাসাগর (বা মহাসমুদ্র, মহাসিন্ধু) অতি প্রকাণ্ড ও লবণযুক্ত বিপুল জলরাশি যা পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ওসেন শব্দটির উৎস হল প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘ওকিআনোজ’ (Ὠκεανός)।[১] স্বীকৃত ৫ টি মহাসাগর : প্রশান্ত, আটলান্টিক, ভারতীয়, আর্টিক, এবং দক্ষিণ[২][৩]। মহাসাগরগুলি একত্রে পৃথিবীর মোট আয়তনের (৩.৬১×১০১৪ বর্গ মিটার) প্রায় ৭০.৯% স্থান দখল করে আছে। এ বিপুল জলরাশি আবার অনেকগুলো মহাসাগর ও ছোট ছোট সমুদ্রে বিভক্ত।


মহাসাগরের অর্ধেকেরও বেশি জায়গার গড় গভীরতা ৩,০০০ মিটারেরও (৯,৮০০ বর্গফুট) বেশি। মহাসাগরের জলের গড় লবণাক্ততা ৩.৫% এবং প্রায় সকল সমুদ্রের গড় লবণাক্ততা ৩% থেকে ৩.৮%৮। বৈজ্ঞানিকেরা হিসেব করে দেখেছেন যে, মহাসাগরে প্রায় ২,৩০,০০০ সামুদ্রিক ও জলজ প্রাণী রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সামুদ্রিক ও জলজ প্রাণীর সংখ্যা নির্ণিত সংখ্যার তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।


পরিচিতি

প্রচলিতভাবে আমরা বিভিন্ন ধরনের মহাসাগরের নাম দেখতে পাই। একসময় বর্তমানকালের মহাসাগরগুলোর আন্তঃসংযোগকৃত লবণাক্ত জলরাশি ‘বৈশ্বিক মহাসাগর’ হিসেবে নির্দেশ করতো। মহাসাগর মূলতঃ একটি। এ ধারণাটি অবিচ্ছেদ্য ও পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং মুক্ত জলরাশির আন্তঃসংযোগে মহাসাগরীয়বিদ্যার মৌলিক গুরুত্বকেই তুলে ধরে। পাশ্চাত্ত্য ভূগোলবিদরা তাদের নিজেদের সুবিধার্থে মহাসাগরকে ৫টি অংশে বিভক্ত করেছেন। মহাসাগরীয় বিভাজনসমূহ সংজ্ঞায়িত এবং মূল্যায়িত হয়েছে - মহাদেশ, মাটির স্তর এবং অন্যান্য শর্তাবলীর আলোকে। সেগুলো হলোঃ-


প্রশান্ত মহাসাগর: এটি আমেরিকাকে এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে বিভক্ত করেছে।

আটলান্টিক মহাসাগর: এটি আমেরিকাকে ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে বিভক্ত করেছে।

ভারত মহাসাগর: এটি দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে রেখেছে এবং আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে বিভক্ত করেছে।

দক্ষিণ মহাসাগর বা এন্টার্কটিকা মহাসাগর: এ মহাসাগর এন্টার্কটিকা মহাদেশকে ঘিরে রেখেছে এবং প্রশান্ত, আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগরের বহিরাংশ হিসেবে নির্দেশিত হচ্ছে।

উত্তর মহাসাগর বা আর্কটিক মহাসাগর: এ মহাসাগরটি আটলান্টিক মহাসাগরের একটি সমুদ্র হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে যা আর্কটিকের অধিকাংশ এলাকা এবং উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়ার একাংশকে ঘিরে রেখেছে।

প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগর বিষুবরেখা কর্তৃক উত্তরাংশ ও দক্ষিণাংশকে আন্তঃবিভাজন করেছে। ক্ষুদ্রতম এলাকাগুলোয় মহাসাগরকে সাগর, উপসাগর, উপত্যকা, প্রণালী ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণে মহাসাগর বলতে সুবিশাল মহাসাগরীয় জলাধারকে বুঝায়। মহাসাগরীয় জলাধার হচ্ছে আগ্নেয়গিরির বাসাল্টের পাতলা স্তর যা পৃথিবীর অগ্নিকুণ্ডস্বরূপ। মহাসাগরীয় প্লেটের কঠিন আবরণের তুলনায় এর আবরণ পুরু হলেও কম ঘণপূর্ণ। এ দৃষ্টিকোণে পৃথিবীতে তিনটি মহাসাগর আছে যা বিশ্ব মহাসাগর, কাস্পিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগর বা ব্ল্যাক সি নামে পরিচিত। শেষোক্ত দু’টি লওরেসিয়াসহ কাইমেরিয়া এলাকায় একত্রিত হয়েছে। ভূ-মধ্যসাগর ঐ সময়েই মহাসাগর থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, টেকটোনিক প্লেট নড়াচড়ার ফলে জিব্রাল্টার প্রণালী থেকে বিশ্ব মহাসাগরের সাথে সম্পর্কচ্যুত হয়। কৃষ্ণ সাগর বসফরাস প্রণালীর মাধ্যমে ভূ-মধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত হয়। কিন্তু বসফরাস প্রণালীর প্রাকৃতিক খালটি মহাদেশীয় শিলাচ্যুতির কারণে প্রায় ৭,০০০ বছর পূর্বে বিচ্ছিন্ন হয় এবং মহাসাগরীয় সাগরতলের একটি টুকরো জিব্রাল্টার প্রণালীর উদ্ভব ঘটে।


মহাসাগরীয় সীমারেখা

মহাসাগর এবং জীবনধারা

ভূ-মণ্ডলে মহাসাগরের বিপুল প্রভাব লক্ষ করা যায়। মহাসাগরীয় বাষ্পীভবন যা পানিচক্রের একটি ধাপ, তা অনেক বৃষ্টিপাতের উৎসস্থল হিসেবে চিহ্নিত তা মহাসাগরীয় তাপমাত্রা জলবায়ু ও বাতাসের গতিপথের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এটি ভূ-স্থিত জীবন ও জীবনধারায় বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। মহাসাগর গঠনের ৩ বিলিয়ন বছরের মধ্যে ভূ-স্থিত জীবন গড়ে উঠে। উপকূলের গভীরতা এবং দূরত্ব উভয়ই বিরাটভাবে প্রভাবান্বিত করেছে বলেই সাগর উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা জন্মেছে এবং সংশ্লিষ্ট প্রাণীকূল বসবাস করছে।


দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়সমূহ

বৈশ্বিক মহাসাগরের আয়তন প্রায় ৩৬১*১০৬ বর্গকিলোমিটার (১৩৯*১০৬ বর্গমাইল)। প্রতি ঘণকিলোমিটারে পানির আয়তন হচ্ছে ১,১১১ কিলোমিটার। মহাসাগরের গড় গভীরতা ৩,৭৯০ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১০,৯২৩ মিটার। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জলরাশি ৩০০০ মিটারেরও গভীরে রয়েছে। মোট বাষ্পীভবন হচ্ছে ১.৪*১০২১ কেজি যা পৃথিবীর মাত্র ০.০২৩%। ৩ শতাংশের কম স্বাদুপানি; বাকী লবণাক্ত পানির প্রায় সবই মহাসাগরের।


রং

সাধারণের ধারণা যে, মহাসাগরের পানির রং নীল। এছাড়াও, পানিতে খুবই কম পরিমাণে নীল রং থাকে এবং যখন বিপুল জলরাশিকে একত্রে রাখা হয় তখনই মহাসাগরের পানি নীল দেখায়। এছাড়াও, আকাশে নীল রংয়ের প্রতিফলন এর জন্য দায়ী, যদিও তা মূখ্য বিষয় নয়। মূল কারণ হচ্ছে - পানির পরমাণুগুলোতে লাল রংয়ের নিউক্লিয়ার কণা থাকে যা আলো থেকে আসে এবং প্রকৃতি প্রদত্ত রংয়ের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে ইলেকট্রনিক, ডাইনামিক বিষয়গুলোর তুলনায় প্রাকৃতিক অণুকম্পনকে ফলাফলকে ধরা হয়।


রক্তিম আভা

নাবিক এবং অন্যান্য নৌ-বিদদের প্রতিবেদনে জানা জায়, মহাসাগরে প্রায়শঃই দৃশ্যমান রক্তিম আভা, আলোকছটা মাইলের পর মাইল রাত্রে দেখা যায়। ২০০৫ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেন যে, আলোকচিত্রের মাধ্যমে গ্লো’র উপস্থিতি তারা নিশ্চিত করেছেন। এটি জৈব-আলোকছটার সাহায্যে ঘটতে পারে।


আবিষ্কার

মহাসাগরে ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অতিপ্রাচীনকাল থেকেই নৌকা যোগাযোগের একটি প্রধান পরিবহন হিসেবে সু-খ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু আধুনিক যুগে জলের নীচ দিয়েও ভ্রমণ করা সম্ভবপর হয়েছে। গভীরতম স্থান হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ হিসেবে নর্দার্ন মারিয়ানা দ্বীপের মারিয়ানা খাতের স্থান নির্ণিত হয়েছে। এর গভীরতা ১০,৯৭১ মিটার। ব্রিটিশ নৌযান চ্যালেঞ্জার-২ ১৮৫১ সালে স্থানটি জরিপ করে এবং সবচেয়ে গভীর স্থানকে নামকরণ করেছে ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’ হিসেবে। ১৯৬০ সালে ট্রিস্ট দু’জন ক্রু-সহ ‘চ্যালেঞ্জার-২’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছতে সফলকাম হন। অধিকাংশ মহাসাগরের কেন্দ্রস্থল এখনো আবিস্কৃত হয়নি এবং স্থানও নির্ণিত হয়নি। ১৯৯৫ সালে মহাকর্ষীয় সূত্র প্রয়োগ করে ১০ কিলোমিটারেরও অধিক বৃহৎ ভূ-চিত্রাবলীর দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে।

সাগর

 সাগর, দরিয়া, বা বিশ্ব মহাসাগর হলো লবণাক্ত জলের পরস্পর সংযুক্ত জলরাশি, যা পৃথিবীর উপরিতলের ৭০ শতাংশেরও বেশি অংশ আবৃত করে রেখেছে। সমুদ্র পৃথিবীর জলবায়ুকে সহনীয় করে রাখে এবং জলচক্র, কার্বন চক্র ও নাইট্রোজেন চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ সমুদ্র পরিভ্রমণ করছে ও সমুদ্রাভিযান চালিয়ে আসছে। তবে সমুদ্র-সংক্রান্ত বিজ্ঞানসম্মত চর্চা বা সমুদ্রবিজ্ঞানের সূচনা ঘটে মোটামুটিভাবে ১৭৬৮ থেকে ১৭৭৯ সালের মধ্যে ক্যাপ্টেন জেমস কুকের প্রশান্ত মহাসাগর অভিযানের সময়।


সমুদ্রের জলে সর্বাধিক পরিমাণে যে ঘনবস্তু দ্রবীভূত অবস্থায় রয়েছে, তা হল সোডিয়াম ক্লোরাইড। এছাড়া অন্যান্য অনেক মৌলের সঙ্গে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের লবণ। কয়েকটি মৌল রয়েছে অতিসূক্ষ্ম কেন্দ্রীভূত অবস্থায়। সমুদ্রজলের লবণাক্ততা সর্বত্র সমান নয়। পৃষ্ঠতল ও বড় বড় নদীর মোহনার কাছে জলের লবণাক্ততা কম; অন্যদিকে সমুদ্রের গভীরতর অংশে লবণাক্ততা বেশি। যদিও বিভিন্ন মহাসাগরগুলির মধ্যে দ্রবীভূত লবণের আপেক্ষিক অনুপাতের পার্থক্য কমই হয়। সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু তরঙ্গ সৃষ্টি করে। সেই তরঙ্গ সমুদ্রের অগভীর স্থানে প্রবেশ করে ভেঙে পড়ে। সমুদ্রের উপরিতলের সঙ্গে বায়ুর ঘর্ষণের ফলে সমুদ্রস্রোতেরও সৃষ্টি হয়। এই সমুদ্রস্রোতগুলি ধীরগতিতে অথচ নিয়মিতভাবে মহাসাগরগুলির মধ্যে জল প্রবাহিত করে। মহাদেশগুলির গড়ন ও পৃথিবীর আবর্তন (কোরিওলিস প্রভাব) ইত্যাদি কয়েকটি কারণ এই প্রবাহের অভিমুখ নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ব পরিবহণ বেষ্টণী নামে পরিচিত গভীর-সমুদ্রস্রোতগুলি মেরু অঞ্চল থেকে ঠান্ডা জল প্রত্যেকটি মহাসাগরে বহন করে আনে। নিজের অক্ষের চারিদিকে পৃথিবীর আবর্তন, পৃথিবীর চারিদিকে পরিক্রমণরত চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বল, সামান্য পরিমাণে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে সাধারণত দিনে দু’বার সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান ও পতন ঘটে। এই ঘটনা জোয়ার-ভাটা নামে পরিচিত। উপসাগর ও নদীর মোহনায় জোয়ার-ভাটার মাত্রা অত্যন্ত বেশি হয়। মহাসমুদ্রের নিম্নবর্তী ভূগর্ভে ভূসাংগাঠনিক পাতের নড়াচড়ার ফলে সমুদ্রের তলদেশে ঘটা ভূমিকম্পের ফলে বিধ্বংসী সুনামির উদ্ভব ঘটে। অবশ্য আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, প্রবল ভূমিধ্বস অথবা উল্কাপিণ্ডের সংঘাতেও অনেক সময় সুনামির সৃষ্টি হয়ে থাকে।


সমুদ্রে বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া, প্রোটিস্ট, শৈবাল, উদ্ভিদ, ছত্রাক ও প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়। এই জন্য সমুদ্রে একটি বৈচিত্রময় সামুদ্রিক বাসস্থান ও বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এই জাতীয় বাসস্থান ও বাস্তুতন্ত্র সমুদ্রের উপরিতলের সূর্যালোকিত জলভাগ ও তটরেখা থেকে উল্লম্বভাবে শীতল ও অন্ধকার সমুদ্রতলস্থ ক্ষেত্রের জলের উচ্চচাপযুক্ত সুগভীর অংশ এবং উত্তর মেরু অঞ্চলের বরফের তলায় স্থিত শীতল জল থেকে অক্ষরেখা বরাবর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বর্ণবৈচিত্র্যময় প্রবাল প্রাচীরগুলি পর্যন্ত প্রসারিত রয়েছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বেশ কিছু প্রধান গোষ্ঠীর বিবর্তন ঘটেছে সমুদ্রে। জীবনের উৎপত্তিও সম্ভবত সমুদ্রেই ঘটেছিল।সমুদ্রের রহস্য ঘেরা আচ্ছাদনে রয়েছে হাজারো বিস্ময়কর প্রাণি- ব্লবফিস, Japanese Spider Crab সহ কোলোসাল স্কুইড সহ আরও অনেক ।


সমুদ্র মানবজাতিকে প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করে। এর মধ্যে মাছই প্রধান। তবে শেলফিস, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সামুদ্রিক শৈবাল পাওয়া যায় সমুদ্র থেকে। এগুলি হয় জেলেরা জাল ফেলে ধরে অথবা জলের তলায় চাষ করা হয়। এছাড়াও মানুষ সমুদ্রকে ব্যবহার করে বাণিজ্য, পর্যটন খনিজ উত্তলোন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যুদ্ধ ও সাঁতার, প্রমোদ ভ্রমণ ও স্কুবা ডাইভিং ইত্যাদি অবকাশ যাপনের কাজে। এই সব কাজকর্মের জন্য সমুদ্র দূষিত হয়। মানব সংস্কৃতিতেও সমুদ্রের গুরুত্ব অসীম। হোমারের ওডিসি মহাকাব্যের যুগ থেকে সাহিত্যে, সামুদ্রিক শিল্পকলায়, থিয়েটারে ও উচ্চাঙ্গ সংগীতে সমুদ্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়। পৌরাণিক সাহিত্যের সিলা ইত্যাদি কয়েকটি ক্ষেত্রে সমুদ্র প্রতীকীভাবে দৈত্য হিসেবে চিত্রিত হয়েছে এবং অচেতন মন ও স্বপ্ন ব্যাখ্যার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।